আবূ সালামাহ ইবনু ‘আবদুর রাহমান (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি ‘আয়িশাহ্ (রাযি.)-কে জিজ্ঞেস করেন যে, রমাযানে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সালাত কিরূপ ছিল? তিনি বললেন, রমাযান মাসে ও রমাযানে ব্যতীত অন্য সময়ে (রাতে) তিনি এগার রাক‘আত হতে বৃদ্ধি করতেন না।[1] তিনি চার রাক‘আত সালাত আদায় করতেন, তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিনি চার রাক‘আত পড়েন। তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। এরপর তিন রাক‘আত সালাত আদায় করতেন। আমি [‘আয়িশাহ (রাযি.)] বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি বিতর আদায়ের আগে ঘুমিয়ে যাবেন? তিনি বললেনঃ হে ‘আয়িশাহ্! আমার দু’চোখ ঘুমায় বটে কিন্তু আমার কালব নিদ্রাভিভূত হয় না।
(সহীহ বুখারী (তাওহীদ),২০১৩, ১১৪৭) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৮৭০, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ১৮৮৩)
[1] তারাবীহর রাক‘আতের সংখ্যা : সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীসের মাধ্যমে রসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে তিন ধরনের সংখ্যা বর্ণনা করা হয়েছেঃ (১) ১১ রাক‘আতঃ আয়িশাহ (রাযি.) থেকে বিভিন্ন সনদে ও ভাষা-ভঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে যে, নাবী (সাঃ) রাত্রিকালে ইশার পরের দু’রাক‘আত ও ফাজরের পূর্বের দু’রাক‘আত সুন্নাত বাদে সর্বমোট এগার রাক‘আত সলাত আদায় করতেন। এক বর্ণনায় এসেছে রসূলুল্লাহ (সাঃ) রমাযান ও অন্যান্য মাসেও রাত্রে ১১ রাক‘আতের বেশী নফল সলাত আদায় করতেন না। (বুখারী হাদীস নং- ১১৪৭, ১১৩৯, ৯৯৪, ২০১৩, মুসলিম- সলাতুল্লাইল ওয়াল বিত্র ৬/১৬,১৭,২৭) (২) ১৩ রাক‘আতঃ ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাত্রিকালে রসূলুল্লাহ (সাঃ) ১৩ রাক‘আত নফল সলাত আদায় করতেন। [বুখারী হাদীস নং ১১৩৮, তিরমিযী (তুহ্ফা সহ) ৪৪০] ইবনু আববাস (রাঃ)-এর হাদীসে ১১ রাক‘আতের চেয়ে দু’রাক‘আত বৃদ্ধি পাওয়া যায়। এ বর্ধিত ২ রাক‘আত এর ব্যাখ্যা বিভিন্নভাবে পাওয়া যায়। নাসাঈ গ্রন্থে ইবনু আববাসের বর্ণিত হাদীসে- ১৩ রাক‘আতের বর্ণনা এসেছে। ৮ রাক‘আত রাত্রের সলাত, তিন রাক‘আত বিত্র ও দু’রাক‘আত ফজরের পূর্বের সুন্নাত। (নাসাঈ ৩/২৩৭, ফাতহুল বারী ২/৫৬২) ফাজরের দু’রাক‘আত সুন্নাত ধরে আয়িশাহ (রাযি.)-ও ১৩ রাক‘আতের কথা বর্ণনা করেছেন। দেখুন বুখারী হাদীস নং ১১৪০, মুসলিম- সলাতুল লাইলি ওয়াল বিত্র ৬/১৭-১৮, ফাতহুল বারী ২/৫৬২, বুখারীতে আয়িশাহ (রাযি.)-এর কোন কোন বর্ণনায় ১১ ও দু’রাক‘আতকে পৃথক করে দেখানো হয়েছে; হাদীস নং ৯৯৪, ১১৪০। যে সমস্ত বর্ণনায় ১৩ রাক‘আতের বিস্তারিত বর্ণনা আসেনি, সে সমস্ত বর্ণনায় ফজরের ২ ক‘আত কিংবা ইশার ২ রাক‘আত সুন্নাত উদ্দেশ্য। (ফাতহুল বারী ২/৫৬২ পৃঃ) কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) রাত্রের সলাত উদ্বোধন করতেন হালকা করে দু’রাক‘আত সলাত আদায়ের মাধ্যমে। হতে পারে এই ২ রাক‘আত নিয়ে ১৩ রাক‘আত। কিন্তু এই ২ রাক‘আত সলাত বিভিন্ন হাদীসের মাধ্যমে ইশার সুন্নাত বলেই প্রতীয়মান হয়। (আলবানী প্রণীত সলাতুত্ তারাবীহ ১৭ নং টীকা) (৩) পনের রাক‘আতঃ ইশার পরের ও ফজরের পূর্বের দু’রাক‘আত সুন্নাত সলাত সহ আয়িশাহ (রাঃ) ও ইবনু আববাস উভয়েই ১৫ রাক‘আত বর্ণনা করেছেন। আয়িশাহ (রাযি.)-এর হাদীস নং ১১৬৪, ইবনু আববাস (রাঃ)-এর হাদীস নং ৯৯২। সহীহ হাদীসসমূহের মাধ্যমে ও পূর্বাপর প্রায় সকল মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহগণের মতে রসূলুল্লাহ (সাঃ) ১১ বা ইশা অথবা ফজরের সুন্নাত মিলিয়ে ১৩ বা উভয় সলাতের সুন্নাত মিলিয়ে ১৫ রাক‘আতের বেশী রাত্রের সলাত পড়েননি। (রমাযান সম্পর্কিত রিসালাহঃ আকরামুজ্জামান বিন আব্দুস সালাম) কেউ বলতে পারেন যে, যদি ১১ বা ১৩ এর অধিক রাক‘আত তারাবীহ পড়া সহীহ হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত না হয় বরং সহীহ সাব্যস্ত হাদীসের বিপরীত হয় তবে সঊদী আরবে মাক্কাহ-মাদীনার মাসজিদদ্বয়ে কেন ২০ রাক‘আত পড়ানো হয়? হ্যাঁ- এ কথা সত্য, তবে মাক্কার মাসজিদুল হারাম, মাসজিদে ‘আয়িশাহ সহ দু’চারটি মাসজিদ এবং মাদীনার মাসজিদে নাববী, কূবা ও ক্বিবলাতাইন এবং বিভিন্ন শহরে দু’একটি করে মাসজিদ ব্যতীত সৌদি আরবের হাজার হাজার মাসজিদে লক্ষ লক্ষ ও কোটি মুসলিম সহীহ হাদীস মোতাবেক ১১ রাক‘আত পড়েন। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যদি ২০ রাক‘আত সহীহ হাদীসের বিপরীত হত তবে মাক্কাহ-মাদীনাহ্র মাসজিদে পালন করা হত না। জবাবে বলা হবে, ৮০১ হিজরী থেকে শুরু করে ১৩৪৩ হিজরী পর্যন্ত সর্বমোট ৫৪২ বৎসর ধরে মাক্কার মাসজিদুল হারামে এক সলাত চার জামা‘আতে আদায় করার জঘন্যতম বিদ‘আত যদি এতদিন চলতে পারে তবে তারাবীর ক্ষেত্রে সহীহ হাদীসের বিপরীত আমল চালু থাকা বিচিত্র কিছু নয়। আজ থেকে ৬৯ বৎসর পূর্বে যেমন চার জামা‘আত উঠে গেছে, সহীহ হাদীস মুতাবিক এক জামা‘আতে আদায় করা হচ্ছে তেমনি এক সময় ২০ রাক‘আত উঠে গিয়ে সহীহ হাদীস মোতাবেক ১১ রাক‘আত চালু হওয়া দূরের কোন ব্যাপার নয়। যে সমস্ত হাদীসের কিতাবে ১১ রাক‘আতের দলীল বিদ্যমান তা উল্লেখ হলো : (বুখারী ১ম খন্ড ১৫৪,২৬৯ পৃষ্ঠা। মুসলিম ২৫৪ পৃষ্ঠা। আবূ দাঊদ ১ম খন্ড ১৮৯ পৃষ্ঠা। নাসাঈ ১৪৮ পৃষ্ঠা। তিরমিযী ৯৯ পৃষ্ঠা। ইবনু মাজাহ ৯৭-৯৮ পৃষ্ঠা। মুয়াত্তা মালিক ১৩৮ পৃষ্ঠা। সহীহ ইবনু খুযাইমাহ ৩য় খন্ড ৩৪১ পৃষ্ঠা। যাদুল মাআদ ১ম খন্ড ১৯৫ পৃষ্ঠা। বুখারী ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৩য় খন্ড হাদীস নং ১৫৯২-১৫৯৭। বুখারী আযিযুল হক ১ম খন্ড হাদীস নং ৬০৮। বুখারী আধুনিক প্রকাশনী ১ম খন্ড হাদীস নং ১০৭৬, ২য় খন্ড হাদীস নং ১৮৭০। মিশকাত নূর মোহাম্মদ আযমী ৩য় খন্ড ও মাদ্রাসা পাঠ্য ২য় খন্ড হাদীস নং ১২২৮। হাদীস শরীফ মাওঃ আব্দুর রহীম ২য় খন্ড ৩৯০ পৃষ্ঠা) বিশ রাক‘আত তারাবীহ প্রসঙ্গ : 1- حديث ابن عباس : أن النبي كان يصلي في شهر رمضان (في غير جماعة) بعشرين ركعة (والوتر) ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ রমাযান মাসে (জামাআত ব্যতীতই) বিশ রাক‘আত তারাবীহ পড়তেন। তারপর বিতর পড়তেন।-এটি জাল হাদীস। হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে ইবনে আবি শায়বা ‘মুসান্নাফ’ ২/৯০/২, আব্দ বিন হামিদ ‘মুনতাখাব মিনাল মুসনাদ’, তাবারানী ‘মু’জামুল কাবীর’ ৩/১৪৮/২ ও ‘আওসাত’ ইবনে আদী ‘কামেল’ ১/২৩, খতীব ‘‘মুওয়াজ্জেহ’’ গ্রন্থে ১/২১৯, বাইহাকী ২/৪৯৬ ও অন্যান্যরা। এদের প্রত্যেকেই আবী শায়বার সনদে এটি বর্ণনা করেছেন। হাদীসের পূর্ণ সনদ নিম্নরূপ- أبي شيبة إبراهيم بن عثمان عن الحكم عن مقسم عن ابن عباس .................... ইমাম তাবারানী বলেন, ইবনে আববাস হতে এই সনদ ব্যতীত অন্য সনদে এটি বর্ণিত হয়নি। ইমাম বাইহাকী বলেন, এটি আবূ শায়বার একক বর্ণনা আর সে হলো যঈফ রাবী। আল্লামা আলবানী (রহঃ) বলেন- ‘‘আর অনুরূপ হাইসামী (রহঃ) বলেছেন যে, এখানে আবূ শায়বা হলো যঈফ’’। হাফিয (রহঃ) বলেন, ইবনে আবি শায়বার সম্পৃক্ততার কারণে সনদটি দুর্বল। হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত হাফিযে হাদীস আল্লামা জামালুদ্দীন যায়লায়ী হানাফী (রহঃ)-ও এর সনদকে যঈফ বলেছেন। তিনি হাদীসের মতনকে অস্বীকার করে বলেন, আর এটি আয়িশাহ (রাযি.) হতে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীসের বিপরীত। আয়িশার হাদীসটি হলো- ما كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يزيد في رمضان ولا في غيره على احدى عشرة ركعة (رواه الشيخان) রসূলুল্লাহ (সাঃ) রমাযানে ও অন্যান্য সময়ে এগারো রাকআতের বেশি পড়তেন না। অতঃপর দেখুন নাস্বুর রায়া ২/১৫৩, হাফিয ইবনু হাজার (রহঃ)-ও একই কথা বলেছেন। ফকীহ আহমাদ বিন হাজার (রহঃ) ‘ফাতাওয়া কুবরা’ গ্রন্থে বলেন- নিশ্চয় ওটি চরম দুর্বল হাদীস أنه حديث شديد الضعف। ইরওয়াউল গালীল ৪৪৫। এছাড়াও সনদে আবূ শায়বা ইবরাহীম বিন ওসমান সম্পর্কে- ইমাম নাসাঈ (রহঃ) বলেন- সে পরিত্যক্ত متروك))। ইমাম শু’বা (রহ.) বলেন, সে মিথ্যাবাদী كذاب))। ইমাম দারেমী (রহ.) বলেন, তার বর্ণিত কথা দলিল হিসেবে গণ্য নয়। মিযানুল ঈতিদাল ১ম খন্ড। আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন, আমার দৃষ্টিতে তিনটি কারণে হাদীসটি জাল। (১) হাদীসটি ‘আয়িশাহ (রাযি.) ও জাবির (রাঃ) বর্ণিত হাদীসের বিপরীত। (২) সনদে আবূ শায়বা দুর্বলতায় চরম যা ইমাম বাইহাকী ও অন্যান্যদের উদ্ধৃতি দ্বারা বুঝা গেছে। তদুপরি তার সম্পর্কে-ইবনে মাঈন বলেছেন, সে নির্ভরযোগ্য নয় ليس بثقة))। জাওযাজানী বলেছেন, সে বর্জিত (ساقط)। শু’বা তাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন। ইমাম বুখারী (রহ.) বলেছেন- তার ব্যাপারে কেউ মত ব্যক্ত করেননি। ইমাম বুখারী যখন কারো সম্পর্কে (سكتوا عنه) বলেন, তখন সেই ব্যক্তির অবস্থান হয় নিকৃষ্টতর ও তার নিকট অধিকতর খারাপ। (৩) আবূ শায়বার হাদীসে বলা হয়েছে যে, নাবী রমাযানে জামাআত ছাড়া নামায পড়েছেন। এটি অনুরূপ জাবির (রাঃ)-এর হাদীসের বিরোধী। ‘আয়িশাহ (রাযি.)-এর অন্য হাদীসে রয়েছে- أَنَّ رَسُولَ اللهِ r خَرَجَ لَيْلَةً مِنْ جَوْفِ اللَّيْلِ فَصَلَّى فِي الْمَسْجِدِ وَصَلَّى رِجَالٌ بِصَلَاتِهِ فَأَصْبَحَ النَّاسُ فَتَحَدَّثُوا فَاجْتَمَعَ أَكْثَرُ مِنْهُمْ فَصَلَّى فَصَلَّوْا مَعَهُ فَأَصْبَحَ النَّاسُ فَتَحَدَّثُوا فَكَثُرَ أَهْلُ الْمَسْجِدِ مِنْ اللَّيْلَةِ الثَّالِثَةِ فَخَرَجَ رَسُولُ اللهِ r فَصَلَّى فَصَلَّوْا بِصَلَاتِهِ নিশ্চয় রসূল (সাঃ) এক রাত্রিতে রাতের মধ্যভাগে বের হলেন এবং মাসজিদে সলাত আদায় করলেন। লোকেরাও তাঁর সাথে সলাত আদায় করল। অতঃপর মানুষেরা সকালে উপস্থিত হয়ে বলাবলি করতে লাগল এবং (দ্বিতীয় দিনে) তাদের চেয়েও বেশি লোক জমায়েত হলো এবং তাঁর সাথে সলাত আদায় করল। এরপর লোকেরা সকালে উপনীত হয়ে (সলাতের ব্যাপারে) বলাবলি করতে লাগল। অতঃপর তৃতীয় রাত্রিতে মাসজিদে মুসল্লীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। অতঃপর রসূলুল্লাহ (সাঃ) বের হয়ে সলাত আদায় করলেন। হাদীসটি জাবির (রাঃ)-এর হাদীসের অনুরূপ। আর তাতে রয়েছে যে- ,لكن خشيت أن تفرض عليكم فتعجزوا عنها বরং আমি ভয় করেছিলাম তোমাদের উপর ফারজ হয়ে যাবার। ফলে তা পালনে তোমরা অপারগ হয়ে পড়বে। সহীহ বুখারী ও মুসলিম। এ সকল দিকগুলোই প্রমাণ করে যে, আবী শায়বার হাদীসটি বানোয়াট। (সিলসিলাতুল আহাদীসিয যঈফা অল-মাওযুআ ৫৬০) ২- حدثنا وكيع عن مالك بن أنس عن يحيى بن سعيد أن عمر بن الخطاب أمر رجلا يصلي بهم عشرين ركعة ইয়াহইয়া বিন সাঈদ হতে বর্ণিত। নিশ্চয় উমার (রাঃ) এক ব্যক্তিকে তাদের সাথে বিশ রাক‘আত নামায পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। হাদীসটি মুনকাতে‘। ইবনে আবী শায়বা- মুসান্নাফ ২য় খন্ড ১৬৩ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৭৬৮২, এই বর্ণনাটি মুনকাতি‘। আল্লামা মুবারাকপুরী ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’ গ্রন্থে বলেছেন, আল্লামা নিমভী (রহঃ) ‘আসার আসসুনান’ গ্রন্থে বলেছেন, ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আনসারী উমার (রাঃ)-এর সময় পান নাই। আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী বলেন, তার সিদ্ধান্ত নিম্ভী (রহঃ)-এর অনুরূপ। এই আসারটি মুনকাতে‘ যা দলিল গণ্য হবার জন্য শুদ্ধ নয়। তদুপরি এটি উমার (রাঃ) হতে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত প্রতিষ্ঠিত হাদীসের বিপরীত। হাদীসটি হলো- حَدَّثَنِي عَنْ مَالِك عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ يُوسُفَ عَنْ السَّائِبِ بْنِ يَزِيدَ أَنَّهُ قَالَ أَمَرَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ أُبَيَّ بْنَ كَعْبٍ وَتَمِيمًا الدَّارِيَّ أَنْ يَقُومَا لِلنَّاسِ بِإِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً ‘উমার (রাঃ) দু’জন সাহাবী (১) উবাই বিন কা‘ব (২) তামীমদারীকে (রমাযান মাসে) ১১ রাক‘আত নামায পড়ানোর নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। (মুয়াত্তা মালিক হাদীস নং ২৫৩) হাদীসটি ‘মুয়াত্তা’ মালিক গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। এমনিভাবে ইয়াহইয়া বিন সাঈদের হাদীস রসূলুল্লাহ (সাঃ) হতে প্রমাণিত বিশুদ্ধ হাদীসের বিরোধী। তাছাড়া ইয়াহইয়া বিন সাঈদকে কেউ কেউ মিথ্যাবাদীও বলেছেন। যেমন, ইমাম আবূ হাতিম (রহঃ) বলেন, ইয়াহইয়া বিন সাঈদ কর্তৃক বর্ণিত কোন কথাই সত্য নয় বরং প্রত্যাখ্যাত। কারণ, সে হলো মিথ্যাবাদী। (জরহে আত্তাদীল ৯ম খন্ড, তাহযীবুত তাহযীব ৬ষ্ঠ খন্ড) عن أبي الحسناء أن عليا أمر رجلا يصلي بهم في رمضان عشرين ركعة. আবুল হাসানা বলেন, আলী (রাঃ) এক ব্যক্তিকে বিশ রাক‘আত তারাবীহ পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ হাদীসের সনদ যঈফ। মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ২য় খন্ড, বাইহাকী ২/৪৯৬, ইমাম বাইহাকী বলেন, এর সনদে দুর্বলতা রয়েছে। আল্লামা আলবানী (রহঃ) বলেন, এতে আবুল হাসানা ত্রুটি যুক্ত। তার সম্পর্কে ইমাম যাহাবী বলেছেন, সে কে তা জানা যায়নি। হাফিয (রহঃ) বলেছেন, সে অজ্ঞাত। আবুল হাসানা কর্তৃক বর্ণিত হাদীস প্রত্যাখ্যাত। মিযানুল ই‘তিদাল ১ম খন্ড, যঈফ সুনানুল কুব্রা ২য় খন্ড, বাইহাকী। عبد العزيز بن رافع قال : كان عن أبى بن كعب يصلي بالناس في رمضان بالمدينة عشرين ركعة ويوتر بثلاث. আব্দুল আযীয বিন রাফে‘ বলেন, উবাই বিন কা‘ব রমাযান মাসে মদীনায় লোকদের সাথে বিশ রাক‘আত (তারাবীহ) নামায পড়েছেন এবং বিতর পড়েছেন তিন রাকাআত। হাদীসটি মুনকাতে‘। মুসান্নাফ আবী শায়বা ২/৯০/১। এখানে আব্দুল আযীয ও উবাই এর মধ্যে ইনকিতা‘ হয়েছে। কেননা, তাদের উভয়ের মৃত্যুর ব্যবধান ১০০ বছর বা তারও অধিক সময়ের। দেখুন- (তাহযীবুত তাহযীব) আর এজন্যই আল্লামা নিম্ভী হিন্দী (রহঃ) বলেছেন যে, আব্দুল আযীয বিন রাফে, উবাই বিন কা‘বের সময় পান নাই। আল্লামা আলবানী বলেন, এখানে উবাই বিন কা‘বের আসারটি মুনকাতে‘। সাথে সাথে এটি উমার (রাঃ) বর্ণিত হাদীসের বিরোধী। (যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে) অনুরূপ এটি উবাই এর সপ্রমাণিত বর্ণনার বিরোধী। বর্ণনাটি হলো- عن أبي بن كعب أنه صلى في رمضان بنسوة في داره ثمان ركعة উবাই বিন কা‘ব বলেন, তিনি রমাযান মাসে তার ঘরে মহিলাদের নিয়ে আট রাক‘আত (তারাবীহ) সলাত আদায় করতেন। অনুরূপ আবূ ইয়ালায় বর্ণিত জাবির (রাঃ)-এর হাদীস- আব্দুল্লাহ বলেন, উবাই বিন কা‘ব রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট এসে বললো, হে আল্লাহর রসূল! রমাযানের রাত্রিতে আমার একটি ব্যাপার ঘটে গেছে। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তা কী হে উবাই! সে বললো, আমার ঘরের নারীরা বলে যে, আমরা কুরআন পাঠ করবো না বরং আপনার সঙ্গে নামায পড়বো? তিনি বললেন, আমি তাদের নিয়ে আট রাক‘আত নামায পড়লাম এবং বিতর পড়লাম। হাইসামী বলেছেন, এর সনদ হাসান, আলবানীর মতও তাই। أخبرنا أبو طاهر الفقيه حدثنا أبو عثمان البصري حدثنا أبو أحمد محمد بن عبد الوهاب حدثنا خالد بن مخلد حدثنا محمد بن جعفر حدثني يزيد بن خصيفة عن السائب بن يزيد قال : كنا نقوم في زمن عمر بن الخطاب بعشرين ركعة والوتر সায়িব বিন ইয়াযীদ বলেন, আমরা উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর সময় ২০ রাক‘আত তারাবীহ ও বিতর পড়তাম। (নাস্বুর রায়া- লিআহাদীসে হিদায়া ২য় খন্ড, ৯৯ পৃষ্ঠা) হাদীসটির সনদ যঈফ। হাদীসের সনদে- (১) আবূ উসমান বাসরী রয়েছে। সে হাদীসের ক্ষেত্রে অস্বীকৃত। (২) খালিদ বিন মুখাল্লাদ রয়েছে। সে যঈফ। তার বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত, তার কোন বর্ণনা দলীল হিসেবে গণ্য নয়। তদুপরি সে ছিল শিয়া ও মিথ্যাবাদী। (তাহ্যীব ২য় খন্ড) (৩) ইয়াযীদ বিন খুসাইফা রয়েছে। তার সকল বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত। (মিযানুল ই’তিদাল, তাহযীবুত্ তাহযীব ২য় খন্ড) ৬- رواية يزيد بن رومان قال : كان الناس يقومون في زمن عمر بن الخطاب في رمضان بثلاثة وعشرين ركعة ইয়াযীদ বিন রুমান বলেন, উমার (রাঃ)-এর সময় লোকেরা (রমাযানে) ২৩ রাক‘আত নামায পড়তো। এটির সনদ যঈফ। মালিক ১/১৩৮, ফিরইয়াবী ৭৬/১, অনুরূপ বাইহাকী ‘সুনান’ ২/৪৯৬ এবং ‘‘মা’রেফা’’ গ্রন্থে আর তাতে তিনি হাদীসটিকে এই বলে যঈফ বলেছেন যে, ইয়াযীদ বিন রুমান উমার (রাঃ)-এর যামানা পান নি। ইমাম যায়লায়ী হানাফী (রহঃ) ও নাস্বুর রায়াহ গ্রন্থে একই কথা বলেছেন- দেখুন নাস্বুর রায়াহ ২/১৫৪। ইমাম নববী (রহঃ)- এটিকে যঈফ বলেছেন, মজমু’ গ্রন্থে। অতঃপর তিনি বলেছেন, হাদীসটি ইমাম বাইহাকী বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সেটি মুরসাল। কেননা, ইয়াযিদ বিন রুমান উমার (রাঃ)-এর সময়ে ছিলেন না (فان يزيد بن رومان لم يدرك عمر) * অনুরূপ আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (রহঃ) এটিকে যঈফ বলেছেন- ‘উমদাতুল কারী শরহে সহীহ বুখারী (৫/৩০৭) গ্রন্থে এই বলে যে, এর সনদ মুনকাতে‘। * আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলাবানী (রহঃ)-ও এটিকে যঈফ বলেছেন। (ইরওয়ালিল গালীল ২/১৯২) তারাবীহর রাক‘আত সম্পর্কে মনীষীদের পর্যালোচনা * শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী হানাফী (রহঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে ২০ রাকআতের প্রমাণ নেই। ২০ রাকআতের হাদীস দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে। যার দুর্বলতার ব্যাপারে সকল হাদীস বিশারদগণ একমত। * হিদায়া গ্রন্থের ব্যাখ্যাকার আল্লামা ইবনেল হুমাম (রহঃ) বলেন, তাবারানী ও ইবনে আবী শায়বার হাদীস দুর্বল এবং বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীসের বিরোধী। ফলে এটি বর্জনীয়। * আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী (রহঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ (সাঃ) হতে কেবলমাত্র ৮ রাক‘আত তারাবীহ-এর হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। ২০ রাক‘আতের হাদীস যঈফ। এ ব্যাপারে সকলে একমত। খুবই সঠিক কথা স্বীকার করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই যে, রসূলুল্লাহর তারাবীহের নামায ছিল ৮ রাক‘আত। (আল-‘উরফুশ শাযী ৩০৯ পৃষ্ঠা) * মোল্লা আলী কারী হানাফী (রহঃ) বলেন, হানাফী শায়খদের কথার দ্বারা বিশ রাক‘আত তারাবীহ বুঝা যায় বটে কিন্তু দলীল প্রমাণ মতে বিতর সহ ১১ রাক‘আতই সঠিক। (মিরকাত ১ম খন্ড) * আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন,২০ রাক‘আতের হাদীস সহীহ হাদীসের বিরোধী হওয়ায় তা বিনা দ্বিধায় বর্জনীয়। একই ধরনের মন্তব্য করেছেন- ইমাম নাসাঈ ‘যুআফা’ গ্রন্থে, আল্লামা আইনী হানাফী উমদাতুল কারী গ্রন্থে, আল্লামা ইবনু আবেদীন ‘হাশিয়া দুররে মুখতার’ গ্রন্থে এবং অন্যান্য বহু মনীষীগণ। বর্তমান জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) তাঁর প্রণীত ‘সলাতুত তারাবীহ’ গ্রন্থে তারাবীহর রাক‘আত সংখ্যা সম্পর্কে বলেন : নাবী (সাঃ) ১১ রাক‘আত তারাবীহ সলাত আদায় করেছেন। যে হাদীসে তাঁর বিশ রাক‘আত পড়ার উল্লেখ রয়েছে তা খুবই দুর্বল। তাই এগার রাক‘আতের বেশি তারাবীহ পড়া জায়িয নয়। কেননা, বৃদ্ধি করাটাই রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কর্মকে বাতিল ও তাঁর কথা অসার করাকে আবশ্যক করে দেয়। আর নাবী (সাঃ)-এর ভাষ্যঃ ‘‘তোমরা আমাকে যেরূপ সলাত আদায় করতে দেখেছ ঠিক সেভাবেই সলাত আদায় করো’’। আর সেজন্যই ফাজরের সুন্নাত ও অন্যান্য সলাতে বৃদ্ধি করা বৈধ নয়। যখন কারোর জন্য সুন্নাত স্পষ্ট হয় না এবং প্রবৃত্তির অনুসরণও করে না, ১১ রাক‘আতের বেশি তারাবীহ পড়ার কারণে তাদেরকে আমরা বিদ‘আতীও বলি না এবং গোমরাহও বলি না। এ ব্যাপারে চুপ থাকাটাই নিঃসন্দেহে উত্তম। কেননা, নাবী (সাঃ)-এর বাণী হলোঃ ‘‘মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর হিদায়াতই উত্তম হিদায়াত’’। আর উমার (রাঃ) তারাবীহ সলাতে কোন নতুনত্বই সৃষ্টি করেননি। বস্তুতঃ তিনি এই সুন্নাতে জামা‘আতবদ্ধতা সৃষ্টি করেছেন এবং সুন্নাতী রাক‘আত সংখ্যার (১১) হিফাজত করেছেন। উমার (রাঃ) সম্পর্কে যে উক্তি বর্ণনা করা হয়- তিনি এ তারাবীহর সংখ্যাকে অতিরিক্ত বিশ পর্যন্ত পৌঁছিয়েছেন- এর সনদের কিছুই সহীহ নয়। নিশ্চয় এর সনদের একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে না এবং সমার্থতার ভিত্তিতে শক্তিশালী বুঝায় না। ইমাম শাফিয়ী (রহঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রহঃ) এটিকে দুর্বল বর্ণনা বলেই নির্দেশনা দিয়েছেন এবং ইমাম নববী (রহঃ), ইমাম যায়লায়ী (রহঃ) সহ অন্যান্যরাও এর কতককে যঈফ সাব্যস্ত করেছেন। যদি উল্লেখিত অতিরিক্ত করাটা প্রমাণিত হয়ও তথাপিও আজকের যুগে তা আমল করা ওয়াজিব নয়। কেননা, অতিরিক্ত করণটি এমন একটি কারণ যা সহীহ হাদীস থাকার কারণে দূর হয়ে গেছে। এই (২০) সংখ্যার উপর বাড়াবাড়ির ফল এই যে, সলাত আদায়কারীরা তাতে তাড়াহুড়া করে এবং সলাতের একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি সলাতের বিশুদ্ধতাও নষ্ট হয়ে যায়। এ অতিরিক্ত সংখ্যা আমাদের গ্রহণ না করার কারণ ঠিক সেরূপ যেমন ইসলামী আইনে উমারের ব্যক্তিগত অভিমতঃ এক বৈঠকে তিন তালাককে তিন তালাক হিসেবে গ্রহণ না করা। আর এতদুভয়ের মাঝে কোনই পার্থক্য নেই। বরং আমরা গ্রহণ করেছি সেই যিনি [নবী (সাঃ)] তাদের (২০ রাক‘আতপন্থীর) গৃহীত ব্যক্তি হতে উত্তম। এমনকি তাদের গৃহীত ব্যক্তি মুকাল্লিদদের নিকটেও উত্তম। সাহাবীদের কেউ ২০ রাক‘আত তারাবীহ পড়েছেন- তার প্রমাণ নেই। বরং ইমাম তিরমিযী (রহঃ) আলী (রাঃ)-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীসটি দুর্বল হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। নিশ্চয় ২০ রাক‘আতের ব্যাপারে ইজমা সাব্যস্ত হয়নি। তাই সুন্নাত সম্মত (১১) সংখ্যাকে আঁকড়ে ধরাই অবশ্য কর্তব্য যা রসূলুল্লাহ (সাঃ) ও উমার (রাঃ) হতে প্রমাণিত। আর আমরাতো আদিষ্ট হয়েছি নাবী (সাঃ) ও তার খালীফা চতুষ্টয়ের সুন্নাত পালনে যারা ছিলেন সঠিক পথের দিশারী। ইমাম মালিক, ইবনুল আরাবীসহ অন্যান্য উলামা এই অতিরিক্ত (২০) সংখ্যাকে অপছন্দ করেছেন।
তারবীর সালাতের রাকাত সংখ্যা |
0 Comments