এপ্রিলের মিথ্যাচার



এপ্রিলের মিথ্যাচার
  মিথ্যা একটি চারিত্রিক ব্যাধি। যার মধ্যে মনুষ্য রুচিবোধ কিংবা সুস্থ প্রকৃতি বিদ্যমান সে কোনক্রমেই এর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করতে পারে না। আর না করাই হচ্ছে স্বাভাবিক মনুষ্য ধর্ম। সকল ধর্মেই এর প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে।
‘পক্ষান্তরে সত্য পৃথিবীর স্থায়িত্বের একটি মূল ভিত্তি। প্রশংসাযোগ্য বস্তু, নবুওয়তের অংশ ও তাকওয়ার ফল। এ সত্য না থাকলে শরিয়তের বিধানসমূহ অকেজো হয়ে যেত।  মূলত মিথ্যা বলার দোষে দুষ্ট হওয়ার অর্থ হচ্ছে মানবতা থেকে বেরিয়ে যাওয়া। কারণ, কথা বলা মানুষের একটি বৈশিষ্ট্য আর কথা সত্য না হলে তার কোন অর্থই থাকে না।’ (মুহাম্মদ আল-খাদেমি: বারীকাতুন মাহমূদিয়া, ৩/১৮৩)
আমাদের পবিত্র দীনে ইসলামে এর সামান্যতম আশ্রয়-প্রশ্রয় নেই। কুরআন, হাদিস এবং উম্মতের ঐকমত্য দ্বারা প্রমাণিত যে এটা হারাম, এটা নিষিদ্ধ ও গর্হিত। যে মিথ্যা বলে তার পরিণাম দুনিয়া ও আখেরাতে খুবই নিন্দনীয়।
নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্ষেত্র ব্যতীত মিথ্যা বলার কোন অবকাশ নেই। এ মিথ্যার মাধ্যমে কারো অধিকার হরণ করা যাবে না, কাউকে হত্যা করা যাবে না এবং কারো ইজ্জত সম্মানে আঘাত হানা যাবে না। বরং কাউকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কিংবা দু’জনের মধ্যে ছিন্ন সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করার জন্য অথবা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিল-মহব্বত তৈরি করার জন্য এ মিথ্যার আশ্রয় নেয়া যাবে, অন্যথায় নয়।
ইসলাম ধর্মে এমন একটি মুহূর্ত কিংবা দিন-ক্ষণ নেই যার মধ্যে মিথ্যা বলা বৈধ বা মানুষ যা চায় তা বলার জন্য সে স্বাধীন। পক্ষান্তরে কতক সমাজে প্রচলিত রেওয়াজ যেমন পহেলা এপ্রিল বা এপ্রিল ফুল নামে যে কুসংস্কার চলে আসছে যে, তাতে মিথ্যা বলা বা কাউকে ধোঁকা দেয়া সম্পূর্ণ বৈধ, তার কোন ভিত্তি ইসলাম ধর্মেই নেই। বরং মিথ্যা সবসময়ই মিথ্যা এবং সবসময় তা হারাম।
মিথ্যার ক্ষতিসমূহ :

§        মিথ্যা বলা হারাম :
১. আল্লাহ তা‘আলা বলেন, 
‘মিথ্যা তো তারাই বানায় যারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের ওপর ঈমান রাখে না। বস্তুত তারাই মিথ্যুক।’ (সূরা নাহাল : ১০৫)
ইবনে কাসির রহ. বলেন, ‘অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, রাসূল সা. মিথ্যা তৈরি করেন না এবং মিথ্যা বলেনও না। কারণ, আল্লাহ এবং তার রাসূলের নামে যারা মিথ্যা রটায় তারা নিকৃষ্ট মাখলুক। তারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের ওপর বিশ্বাস রাখে না, তারা কাফের, তারা নাস্তিক; তারা মানুষের নিকট মিথ্যুক হিসেবে পরিচিত। পক্ষান্তরে রাসূল সা. মানুষের মাঝে সব চেয়ে সত্যবাদী হিসেবে, সব চেয়ে সৎকর্মশীল হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কওমের সবাই তাকে বিশ্বস্ত মুহাম্মদ বা আল-আমীন মুহাম্মদ বলে ডাকত।’ (ইবনে কাসির : ২/৫৮৮)
২. আবুহুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, 
‘মুনাফেকদের নিদর্শন তিনটি : কথা বলার সময় মিথ্যা বলা, ওয়াদা করে ভঙ্গ করা এবং আমানতের মধ্যে খেয়ানত করা।’ (বুখারি : ৩৩, মুসলিম : ৫৯)
ইমাম নববি রহ. বলেন, অধিকাংশ আলেমে রায় হচ্ছে এগুলো মুনাফেকির আলামত ও স্বভাব। যার মধ্যে এগুলো থাকবে সে এসব স্বভাবে মুনাফেকদের ন্যায় ও তাদের আচরণ গ্রহণকারী।
·        আর সব চেয়ে বড় মিথ্যা :
- সব চেয়ে বড় মিথ্যা হচ্ছে আল্লাহ ও তার রাসূল সা. এর ওপর আরোপ করা। এর শাস্তি ভয়াবহ, কেউ কেউ এ জাতীয় মিথ্যুককে কাফের পর্যন্ত বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, 
‘আর তোমাদের জিহ্বা দ্বারা বানানো মিথ্যার ওপর নির্ভর করে বলো না যে, এটা হালাল এবং এটা হারাম, আল্লাহর ওপর মিথ্যা রটানোর জন্য। নিশ্চয় যারা আল্লাহর নামে মিথ্যা রটায়, তারা সফল হবে না।’ (নাহাল : ১১৬)
আলী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, 
‘তোমরা আমার ওপর মিথ্যা বলবে না, যে আমার ওপর মিথ্যা বলবে, সে যেন আগুনে প্রবেশ করে।’ (বুখারি : ১০৬)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, 
‘যে আমার ওপর মিথ্যা বলল, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়।’ (বুখারি : ১১০, মুসলিম : ৩)
ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, ‘এর অর্থ হচ্ছে যে রাসূল সা. এর ওপর মিথ্যা বলবে সে যেন নিজ স্থায়ী ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়।’ (তারিকুল হিজরাতাইন : ১৬৯)
-         বেচাকেনায় মিথ্যা বলা :
সাহাবি আবু যর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, 
‘কেয়ামতের দিন তিন জন ব্যক্তির সঙ্গে আল্লাহ কথা বলবেন না এবং তাদের দিকে তাকাবেন না এবং সংশোধন করবেন না, আরও তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। আবু যর বলেন, রাসূল সা. একথাগুলো তিনবার বললেন। আবু যর বলেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত, তারা ধ্বংস প্রাপ্ত, তাদের পরিচয় কি হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, উপকার করে খোটা প্রদানকারী ব্যক্তি ও মিথ্যা কসমের মাধ্যমে বিক্রয়কারী ব্যক্তি।’ (মুসলিম : ১০৬)
হাকিম ইবন হিযাম থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, 
‘ক্রেতা ও বিক্রেতা ইচ্ছাধীন যতক্ষণ না তারা পৃথক হয়। যদি তারা সত্য বলে ও দোষ-গুণ বর্ণনা করে দেয়, তবে তাদের মধ্যে বরকত প্রদান করা হয়। আর যদি তারা গোপন রাখে ও মিথ্যা বলে তবে তাদের বরকত নষ্ট করে দেয়া হয়।’ (বুখারি : ১৯৭৩, মুসলিম : ৫৩২)
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘আল্লাহ সত্য ও স্পষ্ট করে বলার জন্য আদেশ দিয়েছেন এবং মিথ্যা ও গোপন করার জন্য নিষেধ করেছেন, যেসব ব্যাপারে স্পষ্ট করে বলার প্রয়োজন হয়, সেসব ব্যাপারে। যেমন রাসূল সা. বলেছেন, ‘ক্রেতা ও বিক্রেতা ইচ্ছাধীন যতক্ষণ না তারা পৃথক হয়। যদি তারা সত্য বলে ও দোষ-গুণ বর্ণনা করে দেয়, তবে তাদের মধ্যে বরকত প্রদান করা হয়। আর যদি তারা গোপন রাখে ও মিথ্যা বলে তবে তাদের বরকত নষ্ট করে দেয়া হয়।’ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাথে সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে সদা দণ্ডায়মান হও। কোন কওমের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে কোনভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে না। তোমরা ইনসাফ কর, তা তাকওয়ার নিকটতর।’ মায়েদা : ৮, (মিনহাজুস সুন্নাহ : ১/৬১)
-         স্বপ্নের ব্যাপারে মিথ্যা বলা হারাম :
কেউ কেউ স্বপ্নে কিছু না দেখেও বলে যে, আমি স্বপ্নে এমন এমন দেখেছি, অতঃপর মানুষের কাছে তা বলে বেড়ায়। 
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, 
‘যে ব্যক্তি স্বপ্ন না দেখেও স্বপ্ন দেখার ভান করবে, তাকে দু’টি গমের মাঝে গিরা দিতে বলা হবে, অথচ তা সে করতে সক্ষম  হবে না। আর যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের কথা কান পেতে শুনল, অথচ তারা তাকে তা শোনাতে চায় নি, তার কানে কেয়ামতের দিন শিশা ঢালা হবে, যে ব্যক্তি ছবি অঙ্কন করবে কেয়ামতের দিন তাকে শাস্তি দেয়া হবে  এবং তাকে বলা হবে তাতে রুহ সঞ্চার করতে, অথচ তা করতে সে সক্ষম হবে না।’ (বুখারি : ৬৬৩৫)
মুনাবি রহ. বলেন, ‘দু’টি গমের মাঝে তাকে গিরা দিতে বলা হবে’ এর অর্থ হচ্ছে তাকে সর্বদা শাস্তি দেয়া হবে। জাগ্রত অবস্থার চেয়ে ঘুমন্ত অবস্থার মিথ্যা ব্যাপারে কেন এ কঠিন শাস্তি ? অথচ জাগ্রত অবস্থায় মিথ্যা বলে কাউকে তো হত্যা পর্যন্ত করা যায়। এর উত্তর হচ্ছে, ঘুমন্ত অবস্থায় মিথ্যা বলার অর্থ হল আল্লাহর ওপর মিথ্যা বলা। কারণ, স্বপ্ন নবুয়তের একটি অংশ, তাই নবুওয়তের অংশও আল্লাহর পক্ষ থেকেই। সবার নিকট বিদিত যে, মানুষের ওপর মিথ্যা বলার চেয়ে আল্লাহর ওপর মিথ্যা বলার শাস্তি ভয়াবহ ও কঠিন।’ (ফায়জুল কাদির : ৬/৯৯)
-         সব শোনা কথা বলাও হারাম :
হাফস ইবন আসেম থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেনে
ব্যক্তির মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে তাই বলবে।’ (মুসলিম : ৫)
ইমাম নববি রহ. বলেন,এ সব হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যা যা শোনা যায় তার সব কিছু বলা নিষেধ। কারণ, প্রতিনিয়ত সত্য-মিথ্যা অনেক কিছুই শোনা যায়, অতএব যে ব্যক্তি সব কিছু বলে বেড়াবে তার দ্বারা মিথ্যা প্রচারিত হওয়াই স্বাভাবিক, যার সঙ্গে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক বিদ্যমান থাকবে না। আর এটাই হচ্ছে মিথ্যা, মিথ্যার জন্য ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন দখল নেই। হ্যাঁ, গোনাহগার হওয়ার ইচ্ছা শর্ত।আল্লাই ভাল জানেন।’ (মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থ : ১/৭৫)
-         সব চেয়ে ঘৃণিত হচ্ছে হাসিতামাশাচ্ছলে মিথ্যা বলা :
অনেকে ধারণা করে যে হাসি-রসিকতায় মিথ্যা বলা বৈধ। আর এ থেকেই বিশ্ব ধোঁকা দিবস বা এপ্রিল ফুলের জন্ম। এটা ভুল ধারণা, এর কোন ভিত্তি নেই ইসলাম ধর্মে। রসিকতা কিংবা স্বাভাবিক অবস্থায় মিথ্যা সর্বাবস্থায় হারাম।
ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন
আমি রসিকতা করি ঠিক, তবে সত্য ব্যতীত কখনো মিথ্যা বলি না।’ (তাবরানি ফিল মুজামুল কাবির : ১২/৩৯১, সহিহ আল-জামে : হাদিস নং ২৪৯৪)
আবুহুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত
সাহাবায়ে কেরাম একদা বলল, হে আল্লাহ রাসূল, আপনি তো আমাদের সঙ্গে রসিকতা করেন। তিনি বললেন, ‘আমি সত্য ভিন্ন কিছু বলি না।’ (তিরমিজি : ১৯৯০)
আব্দুর রহমান ইবনে আবি লায়লা রহ. বলেন
রাসূল সা. এর সাহাবিগণ বলেছেন যে, তারা রাসূল সা. সঙ্গে কোন সফরে ছিল, তাদের একজন ঘুমিয়ে পড়লে অপর কেউ তার তীর নিয়ে নেয়, লোকটি ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে ভীত হয়ে যায়। এ দৃশ্য দেখে সবাই হেসে দিল। রাসূল সা. বললেন, তোমরা হাসলে কেন? তারা বলল, কিছু হয়নি। তবে আমি তার তীরটি নিয়েছিলাম আর এতেই সে ঘাবড়ে গেছে। রাসূল সা. বললেন, ‘কোন মুসলিমের জন্য অন্য কোন মুসলিমকে ভয় দেখানো বৈধ নয়।’ (আবুদাউদ : ৫০০৪, আহমদ : ২২৫৫৫, অনুবাদ আহমদ থেকে, সহিহ আল-জামে : ৭৬৫৮)
অপর এক হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন
তোমাদের কেউ কারো আসবাব পত্র ইচ্ছায় বা রসিকতায় ধরবে না, কেউ কারোটা ধরে থাকলে তার উচিত তাকে তা ফেরৎ দেয়া।’ (আবুদাউদ : ৫০০৩, তিরমিজি : ২১৬০, সহিহ আল-জামে : ৭৫৭৮, হাদিসটি হাসান)
-         বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলাচ্ছলে মিথ্যা বলা :
বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলাতেও মিথ্যা থেকে বিরত থাকা জরুরি। কারণ, এটা বাচ্চাদের অন্তরে গেঁথে যায়। রাসূল সা. এর থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমের থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাকে আমার আম্মা একদিন ডাকলেন, তখন রাসূল সা. আমাদের ঘরে বসা ছিলেন, আম্মা বললেন, তুমি আস, আমি তোমাকে দেব। রাসূল সা.  বললেন, তুমি তাকে কি দেয়ার ইচ্ছা করেছ? তিনি বললেন, আমি তাকে খেজুর দেব। রাসূল সা. তাকে বললেন, হ্যাঁ, যদি তুমি তাকে কিছু না দিতে তবে তার সঙ্গে তোমার এটা মিথ্যা বলা হত।আবু হুরায়রা রা. বলেন, যে ব্যক্তি কোন বাচ্চাকে বলল, আস আমি তোমাকে দেব, অতঃপর সে যদি না দেয়, তবে তার এটা মিথ্যা কথা হবে। (আবুদাউদ : ৪৯৯১, হাদিসটি সহিহ আল-জামেতে হাসান বলা হয়েছে, হাদিস নং ১৩১৯)
-         লোক হাসানোর জন্য মিথ্যা বলা :
মুয়াবিয়া ইবন হাইদা বলেন, আমি রাসূল সা. কে বলতে শুনেছি
ধ্বংস তার জন্য যে, লোক হাসানোর জন্য কথা বলে এবং তাতে সে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। ধ্বংস তার জন্য, ধ্বংস তার জন্য।’ (তিরমিজি : ২৩৫, তিনি বলেছেন, হাদিসটি হাসান, আবুদাউদ : ৪৯৯০)
§        মিথ্যার পরিণাম :

মিথ্যা বলার পরিণাম খুবই ধ্বংসাত্মক। এর জন্য দুনিয়াতে রয়েছে ধ্বংস আর আখেরাত রয়েছে অপমান ও লাঞ্ছনা। নিম্নে কয়েকটি তুলে ধরা হল :

ক. মিথ্যার কারণে অন্তরে কপটতার সৃষ্টি হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন
সুতরাং পরিণামে তিনি তাদের অন্তরে নিফাক রেখে দিলেন সেদিন পর্যন্ত, যেদিন তারা তার সাথে সাক্ষাৎ করবে, তারা আল্লাহকে যে ওয়াদা দিয়েছে তা ভঙ্গ করার কারণে এবং তারা যে মিথ্যা বলেছিল তার কারণে।’ (তওবা : ৭৭) 
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেন,মুনাফিকদের পরিচয় তিনটি : যখন কথা বলবে মিথ্যা বলবে, আর ওয়াদা করে ভঙ্গ করবে ও আমানত রাখলে খেয়ানত করবে। অতঃপর তিনি দলিল স্বরূপ সুরা তওবার ৭৫-৭৭ পর্যন্ত আয়াতগুলো তেলাওয়াত করেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা : ৬/১২৫)

খ. মিথ্যা পাপাচার ও জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, 
‘সত্যবাদিতা হচ্ছে শুভ কাজ। আর শুভ কাজ জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। আর বান্দা যখন সত্য বলতে থাকে, একসময় আল্লাহর নিকট সে সিদ্দিক হিসেবে পরিগণিত হয়। আর মিথ্যা হচ্ছে পাপাচার, পাপাচার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়, বান্দা যখন মিথ্যা বলতে থাকে, আল্লাহর নিকট একসময় সে মিথ্যুক হিসেবে গণ্য হয়। (বুখারি : ৫৭৪৩, মুসলিম : ২৬০৭)
সানআনি বলেন, ‘হাদিসে এর প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে, বান্দা সত্য বললে সত্যবাদিতা তার একটি আলামত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে বান্দা মিথ্যা বললে মিথ্যা বলা তার অভ্যাস ও আলামতে পরিণত হয়। সত্যবাদিতা ব্যক্তিকে জান্নাতে নিয়ে যায় আর মিথ্যা ব্যক্তিকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। অধিকন্তু সত্যবাদীর কথার প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকে ও তা মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্যতা পায় আর মিথ্যুকদের কথার প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকে না এবং মানুষের নিকট তা গ্রহণযোগ্যতাও পায় না।’ (সুবুলুস্‌সালাম : ২/৬৮৭)

গ. মিথ্যুকদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় না।
ইবনুল কাইয়ূম রহ. বলেন, যেসব কারণে ফতোয়া, সাক্ষ্য ও  বর্ণনা পরিত্যাগ করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মিথ্যা। মিথ্যা মানুষের মুখের কার্যকারিতাই নষ্ট করে দেয়। যেমনিভাবে অন্ধ ব্যক্তির চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয় এবং বধির ব্যক্তির শোনার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, মুখ একটি অঙ্গের ন্যায় যখন তা মিথ্যা বলা আরম্ভ করবে তখন তার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাবে। বরং মানুষের ক্ষতির মূল কারণই হচ্ছে মিথ্যা জবান।’ (আলামুল মুয়াক্কিঈন : ১/৯৫)

ঘ. মিথ্যার কারণে দুনিয়া আখেরাত উভয় জাগতেই চেহারা বিবর্ণ ও মলিন হয়ে যায়
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, 
‘আর যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে কিয়ামতের দিন তুমি তাদের চেহারাগুলো কালো দেখতে পাবে।’ (জুমার : ৬০) 
আল্লাহ এবং তার রাসূলের ওপর মিথ্যা বলার শাস্তি হচ্ছে চেহারা কালো হয়ে যাওয়া।

ঙ. হাদিস দ্বারা প্রমাণিত মিথ্যুকের চোয়াল চিরে গর্দান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে।
সামুরা ইবন জুনদুব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: 
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায়ই বলতেন, “তোমাদের কেউ কি কোনো স্বপ্ন দেখেছে?” তখন আল্লাহ যা মঞ্জুর করেন, তা কেউ কেউ বর্ণনা করতেন। একদিন প্রত্যুষে তিনি বললেন, আমার কাছে রাতে (স্বপ্নে) দু জন আগন্তুক এসেছিল। তারা আমাকে উঠালো এবং বলল, আমাদের সাথে চলুন। আমরা গেলাম, তখন এমন এক ব্যক্তির নিকট পৌঁছলাম, যে তার পিঠের উপরে শুয়ে ছিল আর অন্য একজন লোহার কাঁচি নিয়ে তার উপরে দণ্ডায়মান ছিল। সে তার চেহারার এক পার্শ্বে এসে তার চোয়াল চিরে গর্দান পর্যন্ত, তার নাসিকা চিরে গর্দান পর্যন্ত এবং তার চক্ষু চিরে গর্দান পর্যন্ত কেটে নিয়ে যাচ্ছিল। .... অতঃপর অপর চেহারার অপর পার্শ্বে গিয়ে এ পার্শ্বে যা করেছিল তাই করল। এক পার্শ্ব শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আবার তা পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেত। ফলে সে অপর পার্শ্বে গিয়ে পুনরায় একই কাজ করত।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আমি বললাম, সুবহানাল্লাহ!! এই দু জন কারা? তারা আমাকে বলল, সামনে এগিয়ে যান, সামনে এগিয়ে যান।” (অতঃপর ফেরেশতা দু জন তিনি যা দেখেছেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলল:) “আপনি যে লোককে দেখেছেন তার চোয়াল গর্দান পর্যন্ত, তার নাসিকা চিরে গর্দান পর্যন্ত এবং তার চক্ষু গর্দান পর্যন্ত চিরে নেওয়া হচ্ছিল, সে হলো ঐ ব্যক্তি, যে তার ঘর থেকে সকালে বের হয়ে এমন এক মিথ্যা কথা বলে, যা দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে।” (বুখারি : ৫৭৪৫)
§        মিথ্যা সম্পর্কে মনীষীদের উক্তি:

-         আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: ‘কোনো মানুষ সত্য বলবে এবং সত্য বলার প্রচেষ্টায় থাকবে, অবশেষে তার অন্তরে সুঁই পরিমাণ স্থান থাকবে না মিথ্যার জন্য। আবার, কোনো মানুষ মিথ্যা বলবে এবং মিথ্যা বলতে চেষ্টা করবে, অবশেষে তার অন্তরে সুঁই পরিমাণ স্থানও অবশিষ্ট থাকবে না সত্যের জন্য।’
আরও বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: ‘রসিকতা কিংবা একান্তভাবে— কখনোই মিথ্যা বলবে না।’ অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করেন: 
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্‌র তাক্ওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।” [সূরা আত-তাওবা: ১১৯]
-         আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: ‘তোমরা মিথ্যা থেকে সাবধান থাক! কেননা, মিথ্যা ঈমানের পরিপন্থী।’
-         সাদ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: ‘একজন মুমিন ব্যক্তির মধ্যে মিথ্যা ও বিশ্বাসঘাতকতা ব্যতীত সকল চরিত্রই থাকতে পারে।’
-         উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: ‘কখনওই সত্যিকারের ঈমানে পৌঁছতে পারবে না, যতক্ষণ না ঠাট্টাচ্ছলে মিথ্যা বলা ত্যাগ না করতে পার।’
(মুসান্নাফ ইবন আবী শায়বা: ৫/২৩৫, ২৩৬)
§        যেসব কারণে মিথ্যা বলা যায় :

তিন জায়গায় মিথ্যা বলা বৈধ। ১. যুদ্ধে মিথ্যা বলা বৈধ। ২. দুগ্রুপের মাঝে সমঝোতা করার জন্য মিথ্যা বলা বৈধ। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মিল-মহব্বত সৃষ্টি করার জন্যও মিথ্যা বলা বৈধ।
উম্মে-কুলসুম রা. বলেন, আমি রাসূল সা. কে বলতে শুনেছি : 
যে ব্যক্তি দুজনে মাঝে সমঝোতা করার জন্য ভালো কথার আদান-প্রদানকালে মিথ্যা বলে সে মিথ্যুক নয়।’ (বুখারি : ২৫৪৬, মুসলিম : ২৬০৫)
আসমা বিনতে ইয়াজিদ বলেন, রাসূল সা. বলেছেন
তিন জায়গা ব্যতীত মিথ্যা বলা বৈধ নয়। স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য মিথ্যা বলা, যুদ্ধে মিথ্যা বলা এবং দুজনের মাঝে সমঝোতা করার জন্য মিথ্যা বলা বৈধ। তিরমিজি : ১৯৩৯, সহিহ আল-জামে : ৭৭২৩)
§        এপ্রিল ফুল (APRIL FOOL) বা এপ্রিলের বোকা :

এপ্রিল ফুল সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায়নি, তবে এ সম্পর্কে অনেক বর্ণনা ও মতামত পাওয়া যায়। এপ্রিল ফুল নিয়ে কারও কারও বক্তব্য হচ্ছে :
আমরা অনেকেই এপ্রিল ফুল বা বিশ্ব বোকা দিবসউদযাপন করে থাকি। অথচ এ দিবসের জন্ম রহস্য বা এর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। প্রায় হাজার বছর পূর্বে মুসলিমরা যখন স্পেন শাসন করছিল, মুসলিমদের শক্তি অপ্রতিরোধ্য ছিল এবং খ্রিষ্ট-জগৎ বিশ্ব থেকে মুসলামনদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিল, যে ব্যাপারে তারা এক ধরণের সফলতাও পায়, সে সময়ের ঘটনা এটি। স্পেন থেকে মুসলিমদের উৎখাত করার জন্য খ্রিষ্ট-জগৎ অনেকবারই চেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু তারা সফল হতে পারেনি। তাই তারা মুসলিমদের এ অপ্রতিরোধ্য শক্তি রহস্য জানার জন্য গোয়েন্দা নিয়োগ করল। গোয়েন্দা বাহিনীর রিপোর্ট দিল যে, মুসলিমদের আত্মিক শক্তির মূল রহস্য হচ্ছে তাকওয়া। তারা একমাত্র আল্লাহকে ভয় করে বলেই অন্য কাউকে ভয় পায় না।
যখন তাদের নিকট মুসলিমদের শক্তির রহস্য উদ্ঘাটন হয়ে গেল, তখন তারা এর মূলে আঘাত হানার জন্য মদ এবং নেশাজাতীয় সামগ্রী স্পেনে রফতানি আরম্ভ করল। তাদের এ কৌশল কার্যকর প্রমাণ হলো। ধীরে ধীরে মুসলিমদের ঈমান দুর্বল হতে লাগল। এক সময় পাশ্চাত্যের ক্যাথলিক খৃস্টানরা স্পেনের সকল যুবকদের কাবু করে ফেলল। প্রায় আট শ বছর যাবৎ মুসলিমদের যে রাজত্ব চলে আসছিল তার সর্ব শেষ ঘাঁটি গ্রানাডার পতন ঘটে পহেলা এপ্রিল। আর এজন্য একে এপ্রিলের বোকা বা ধোঁকা বলা হয়।
তখন থেকেই তারা এর দিবসটি পালন করে আসছে। মুসলিমদের বোকা বানানোর সে দিনটিকেই তারা এভাবে উদযাপন করে এপ্রিল ফুল নামে।
তারা এ বোকামি ও ধোঁকাবাজি শুধু গ্রানাডার বাহিনীর জন্য মনে করছে না বরং এ ধোঁকা তারা সমগ্র মুসলিম জাতির জন্য মনে করছে এবং সবার ওপরই একে চাপিয়ে দিচ্ছে। আমরা যদি এ সব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি বা অন্ধদের ন্যায় এর অনুকরণ করি তবে এটা আমাদের জ্ঞানের দীনতা ভিন্ন বলার কিছু নেই। আমরা যদি এর মূল ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হই তবে আমাদের পরাজয়ের দিনে আমাদের উৎসব পালন করা কখনই সম্ভব হত না। বরং স্পেন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের কর্তব হচ্ছে এসব অনুষ্ঠান প্রত্যাখ্যান করা এবং সত্যিকার ইসলামকে আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করা। আর কোনভাবেই আমাদের ঈমানে দুর্বলতা আসে এমনসব জীবন গ্রহণ না করা।
এদিন মানুষ বিভিন্ন ধরণের মিথ্যা বলে থাকে। যেমন : কারো সন্তান, স্ত্রী বা ঘনিষ্ঠ কারও মৃত্যুর সংবাদ দেয়, ফলে সংবাদ গ্রহীতা এর দুঃখ সইতে না পেরে অনেক সময় মৃত্যু বরণ করে। আবার কারো চাকুরী চলে যাওয়া, কারো স্ত্রীর ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ দেয়া, কারো আগুনে পুড়ে যাওয়া বা অসুখ ইত্যাদির ব্যাপারে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে। কারণে হত্যা, তালাক ও অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে থাকে- যা কখনোই কাম্য নয়।
তাই আমাদের ইসলাম ধর্ম এ ধরনের মিথ্যা, ধোঁকাবাজি ও প্রতারণাকে হারাম ঘোষণা করেছে।
(মূল থেকে সামান্য সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে)
সমাপ্ত

 লেখক: শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-মুনাজ্জিদ
 অনুবাদক:
সানাউল্লাহ নজির আহমদ
 সম্পাদনা:
আলী হাসান তৈয়ব
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব

Post a Comment

0 Comments