بسم الله الرحمن الرحيم
ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা
আল্লাহর জন্য; আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর নিকট সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা
করি; তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করি; তাঁর উপর ভরসা করি; আর আমাদের নফসের
জন্য ক্ষতিকর এমন সকল খারাপি এবং আমাদের সকল প্রকার মন্দ আমল থেকে আল্লাহর
নিকট আশ্রয় চাই। সুতরাং আল্লাহ যাকে পথ প্রদর্শন করেন, তাকে পথভ্রষ্ট করার
কেউ নেই; আর যাকে তিনি পথহারা করেন, তাকে পথ প্রদর্শনকারীও কেউ নেই। আর আমি
সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তাঁর কোন শরীক নেই
এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের নেতা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, যাকে তিনি সত্যসহকারে কিয়ামতকে
সামনে রেখে সুসংবাদ দাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারীরূপে পাঠিয়েছেন। যে
ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, সে সঠিক পথ পাবে; আর যে
ব্যক্তি তাঁদের অবাধ্য হবে, সে তার নিজেরই ক্ষতি করবে এবং সে আল্লাহর কোন
ক্ষতি করতে পারবে না।
অতঃপর...
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর পবিত্র কিতাবে বলেন:
﴿ لُعِنَ
ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِنۢ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ عَلَىٰ لِسَانِ دَاوُۥدَ
وَعِيسَى ٱبۡنِ مَرۡيَمَۚ ذَٰلِكَ بِمَا عَصَواْ وَّكَانُواْ يَعۡتَدُونَ
٧٨ كَانُواْ لَا يَتَنَاهَوۡنَ عَن مُّنكَرٖ فَعَلُوهُۚ لَبِئۡسَ مَا كَانُواْ يَفۡعَلُونَ ٧٩ ﴾ [سورة المائدة: 78-79]
“বনী
ইরাঈলের মধ্যে যারা কুফরী করেছিল, তারা দাঊদ ও ঈসা ইবন মারইয়াম কর্তৃক
অভিশপ্ত হয়েছিল—এটা এই জন্য যে, তারা ছিল অবাধ্য ও সীমালংঘনকারী। তারা যেসব
গর্হিত কাজ করত, তা থেকে তারা একে অন্যকে বারণ করত না। তারা যা করত, তা
কতই না নিকৃষ্ট।” — (সূরা আল-মায়িদা: ৭৮-৭৯)
সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«مَنْ
رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ
يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ
أَضْعَفُ الإِيمَانِ» (رواه مسلم في صحيحه).
“তোমাদের মধ্যে যে
ব্যক্তি কোন অশ্লীল কাজ দেখে, সে যেন তা হাত দ্বারা প্রতিরোধ করে; আর যদি
তাতে সে অক্ষম হয়, তবে সে যেন তার মুখ দ্বারা তার প্রতিবাদ করে; আর সে যদি
তাতেও অক্ষম হয়, তবে সে যেন তার অন্তর দ্বারা তা প্রতিরোধের পরিকল্পনা করে;
আর তা হচ্ছে ঈমানের দুর্বলতা”। — (মুসলিম, ঈমান, বাব নং- ২২, হাদিস নং-
১৮৬)
আর দীনের ক্ষেত্রে
ঈমানের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অন্যতম মন্দ কাজ হল
রাফেযী শিয়াদের ফিতনা, যার দিকে তার অনুসারীগণ প্রতিটি জায়গায় দাওয়াতী
তৎপরতা চালাচ্ছে। আর তারা জনগণের কাছে প্রকাশ করে যে, শিয়া মাযহাব ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের
প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের মধ্যে বড় ধরনের কোন পার্থক্য নেই। আহলে সুন্নাত
ওয়াল জামাত ও শিয়াদের মধ্যকার বিরোধ হল বিভিন্ন বিষয়ের শাখা-প্রশাখায় অতি
সামান্য সাদাসিধে বিরোধ।
প্রকৃতপক্ষে
বিষয়টি এই রকম নয়; বরং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত ও শিয়াদের মধ্যকার বিরোধটি
মৌলিক এবং প্রধান আকিদাসমূহের মধ্যে। আর তা এত জঘন্য যে, তার অনুসারী
ব্যক্তি মুসলিম মিল্লাত থেকে খারিজ হয়ে যায়।
তাছাড়া আহলে
সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সাধারণ অনুসারীদের এই মারাত্মক বিরোধ সম্পর্কে কোন
জ্ঞান নেই; এমনকি সাধারণ শিয়াদের অধিকাংশই জানে না শিয়াদের ভ্রান্ত আকিদা
সম্পর্কে। কারণ, শিয়া আলেমগণ যেসব মৌলিক গ্রন্থের উপর তাদের মাযহাব
নির্ভরশীল, সেগুলো সাধারণ জনসমক্ষে প্রকাশ করে না।
এই জন্য আমরা পাকিস্তান আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত সংগঠনের সভাপতি সম্মানিত শাইখ মুহাম্মদ
আবদুস সাত্তার আততুনসাবীকে অনুরোধ করেছি যাতে তিনি আল্লাহর কিতাব ও তাঁর
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ বিরোধী গুরুত্বপূর্ণ শিয়া
আকিদাসমূহ একটি সংক্ষিপ্ত পুস্তকে সংকলন করেন; যা হবে জনগণের জন্য জাফরীয়া
শিয়াদের মতবাদের উপর একটি প্রামাণ্য দলিল এবং তাদের জন্য তার (জাফরীয়া
শিয়াদের মতবাদের) ভ্রান্ত ও অসার দিকগুলো সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
আর তিনিও তাতে সাড়া দিয়েছেন (আল্লাহ তাঁকে এই জন্য উত্তম পুরস্কার দান করুন) এবং এই মূল্যবান সংক্ষিপ্ত পুস্তিকাটি রচনা করছেন।
আর সম্মানিত শাইখ মুহাম্মদ
আবদুস সাত্তার আততুনসাবী দেওবন্দ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬
খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষাসনদ লাভ করেন। তাঁর ওস্তাদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন
আল্লামা শাইখুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানী, যিনি শিয়া আকিদার গুরুত্ব অনুভব
করার পর তাঁকে লাখনু যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, যাতে তিনি এই বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ইমাম শাইখ আবদুস শুকুর লাখনুবী’র নিকট থেকে ফায়দা হাসিল করতে পারেন। অতঃপর তিনি ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে লাখনু গমন করেন এবং শিয়াদের যুক্তি খণ্ডনের উপর বিশেষ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য শাইখ
লাখনুবী’র নিকট কয়েক মাস অবস্থান করেন; তিনি তাঁর নিকট এই বিষয়ে প্রচুর
অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। অতঃপর তিনি ভারত ও পাকিস্তান নামে দেশ বিভক্তির পর
নাজাফ, কারবালা ও তেহরানে গমন করেন এবং শিয়াদের কেন্দ্রসমূহ যিয়ারত করেন
এবং তাদের গ্রন্থসমূহ ও তথ্যপঞ্জি’র উপর দক্ষতা অর্জন করেন, যা তিনি
লাখনুতে অর্জন করতে পারেন নি। অতঃপর তিনি তাঁর দেশ পাকিস্তানে ফিরে যান এবং
ঐ দিন থেকেই তিনি “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত সংগঠন”-এর মঞ্চে বসে এই
ময়দানে সংগ্রাম করতে থাকেন। আর তাঁর হাতে হাজার হাজার শিয়া তাওবা করে; আর
তাদের বড় বড় আলেমগণ তাঁর সাথে বিতর্ক করে এবং আল্লাহ ইচ্ছায় তিনি তাদেরকে
পরাজিত করেন; এমনকি শেষ পর্যন্ত শিয়াগণ তাঁকে ভয় পেতে লাগল এবং তারা তাঁর
সাথে বিতর্কে আর অগ্রসর হতে চাইত না।
আর এই পুস্তিকাটি
আকারে ছোট, বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে মূল্যবান। আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া
তা‘আলা’র নিকট প্রত্যাশা করি, তিনি যেন তা ভালভাবে গ্রহণ করেন এবং তাকে
তাঁর বান্দাদের জন্য হেদায়াতের মাধ্যম বা উপায় বানিয়ে দেন।
وصلى الله على سيدنا محمد و آله و صحبه وسلّم تسليمًا
بسم الله الرحمن الرحيم
الحمد لله رب العالمين. و الصلاة و السلام على خاتم الأنبياء وسيد المرسلين وعلى آله الطيبين وأصحابه البررة المتقين وأزواجه أمهات المؤمنين والتابعين لهم بإحسان أجمعين.
(সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য; আর সালাত (দুরূদ) ও সালাম সর্বশেষ নবী ও রসূলদের নেতা (মুহাম্মদ) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং এবং
শান্তি বর্ষিত হউক তাঁর পবিত্র পরিবার-পরিজন, পুণ্যবান তাকওয়ার অধিকারী
সাহাবীবৃন্দ ও তাঁর স্ত্রী মুমিন জননীগণের প্রতি এবং অতি উত্তমভাবে তাঁদের
সকল অনুসারীদের প্রতি) ।
অতঃপর:
এটা সংক্ষিপ্ত
নিবেদন, যার দ্বারা আমি আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি কামনা করছি এবং (এটা)
আমার মুসলিম ভাইদের জন্য উপদেশ, যাতে তা হতে পারে সত্যের সন্ধানী’র জন্য
হেদায়াতের মশাল এবং সরল সঠিক পথের অনুসন্ধানকারীদের জন্য সুপথের দিশা
দানকারী আলোকস্তম্ভ। হে আল্লাহ! আমাদেরকে সত্যকে সত্যরূপে দেখাও এবং
আমাদেরকে তার অনুসরণ করার তাওফিক দান কর; আর বাতিলকে বাতিলরূপেই আমাদেরকে
দেখাও এবং তার থেকে দূরে থাকার তাওফিক আমাদেরকে দাও।
আর আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿فَإِنَّهَا لَا تَعۡمَى ٱلۡأَبۡصَٰرُ وَلَٰكِن تَعۡمَى ٱلۡقُلُوبُ ٱلَّتِي فِي ٱلصُّدُورِ ٤٦﴾ [سورة الحج: 46]
“বস্তুত চোখ তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে বক্ষস্থিত হৃদয়।” — (সূরা আল-হাজ্জ: ৪৬)
তিনি আরও বলেন:
﴿وَأَنَّ هَٰذَا صِرَٰطِي مُسۡتَقِيمٗا فَٱتَّبِعُوهُۖ وَلَا تَتَّبِعُواْ ٱلسُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمۡ عَن سَبِيلِهِ﴾ [سورة الأنعام: 153]
“আর এই পথই আমার সরল পথ সুতরাং তোমরা এর অনুসরণ করবে এবং বিভিন্ন পথ অনুসরণ করবে না, করলে তা তোমাদেরকে তার পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে”। — (সূরা আল-আন‘আম: ১৫৩)
তিনি আরও বলেন:
﴿أَرَءَيۡتَ مَنِ ٱتَّخَذَ إِلَٰهَهُۥ هَوَىٰهُ﴾ [سورة الفرقان: 43]
“তুমি কি তাকে দেখ না, যে তার কামনা-বাসনাকে ইলাহরূপে গ্রহণ করে”? — (সূরা আল-ফুরকান: ৪৩)
তিনি আরও বলেন:
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ فَرَّقُواْ دِينَهُمۡ وَكَانُواْ شِيَعٗا لَّسۡتَ مِنۡهُمۡ فِي شَيۡءٍ﴾ [الأنعام: 159]
“যারা দীন সম্পর্কে নানা মতের সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের কোন দায়িত্ব তোমার নয়”। — (সূরা আল-আন‘আম: ১৫৯)
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«تركت فيكم أمرين لن تضلوا ما تمسكتم بهما كتاب الله وسنة نبيه » (أخرجه الإمام مالك في الموطأ).
“আমি
তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি; যা তোমরা আঁকড়ে ধরে রাখতে পারলে
কখনও পথভ্রষ্ট হবে না; সেই বস্তু দু’টি হল: আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর
সুন্নাহ।” — (ইমাম মালেক, মুয়াত্তা, মানাকিব অধ্যায়, হাদিস নং- ৩৭৮৬)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:
«وتفترق
أمتي على ثلاث وسبعين ملة كلهم في النار إلا ملة واحدة قالوا ومن هي يا
رسول الله قال: ما أنا عليه وأصحابي » (أخرجه الترمذي).
“আর
আমার উম্মত তিহাত্তর দলে বিভক্ত হবে; একটি দল ছাড়া বাকি সব ক’টি দলই
জাহান্নামের অধিবাসী হবে। সাহবীগণ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! সেই দল করা?
তিনি বললে: সেই দল হল যার উপর আমি এবং আমার সাহাবীগণ রয়েছে।” — (তিরমিযী,
ঈমান, বাব নং- ১৯, হাদিস নং- ২৬৪১)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:
«إذا رأيتم الذين يسبون أصحابي فقولوا لعنة الله على شركم» (أخرجه الترمذي).
“তোমরা
যখন তাদেরকে দেখবে, যারা আমার সাহাবীদেরকে গালি দেয়, তখন তোমরা বলবে:
তোমাদের নিকৃষ্টদের উপর আল্লাহর লানত (অভিশাপ)”। — (তিরমিযী, মানাকিব,
হাদিস নং- ৩৮৬৬)
ইবনু ‘আসাকির বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«
إذا ظهرت البدعُ ولَعَنَ آخرُ هذه الأمةِ أولَها فمن كان عنده علم
فلينشرْه فإنَّ كاتمَ العلمِ يومئذٍ ككاتمِ ما أنزل اللهُ على محمدٍ صلى
الله عليه وسلم» (ابن عساكر عن معاذ).
“যখন বিদ‘আত
প্রকাশ পাবে এবং এই উম্মতের পরবর্তীগণ পূর্ববর্তীদেরকে অভিশাপ দেবে, তখন
যার নিকট জ্ঞান আছে, সে যেন তা প্রকাশ করে; কারণ, সেই দিন ইলম তথা জ্ঞান
গোপনকারী হবে ঐ ব্যক্তির মত, যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা গোপন করে।” — (ইবনু ‘আসাকির মু‘আয রা. থেকে); আল্লামা সুয়ুতী র. ‘জামে সগীর’-এ অনুরূপ বর্ণনা করেছেন[1]।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:
« ذا لَعَنَ آخِرُ هَذِهِ الْأُمَّة أَوَّلِهَا , فَمَنْ كَتَمَ حَدِيثًا فَقَدْ كَتَمَ مَا أَنْزَلَ اللَّه»
“যখন উম্মতের
পরবর্তীগণ পূর্ববর্তীদেরকে অভিশাপ দেবে, তখন যে ব্যক্তি হাদিস গোপন করবে,
তবে সে যেন আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা গোপন করল।” — (ইবন মাজাহ, ইফতিতাহুল
কিতাব ফিল ঈমান..., বাব নং- ২৪, হাদিস নং- ২৬৩[2])
এই কথা পরিষ্কার
যে, এই যুগে ছড়িয়ে পড়েছে নাস্তিকতা, কুটিলতা, পাপাচার, বিদ‘আত, ইসলাম ও তার
নিদর্শনসমূহের সমালোচনা এবং পূর্ববর্তী উম্মত তথা রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী ও তাবেয়ীদের নিন্দা; আরও ছড়িয়ে
পড়েছে নানারকম ফিতনা বা বিশৃঙ্খলা। বাতিলপন্থীগণ তাদের ভ্রান্ত মতবাদ
দ্বারা আল্লাহর বান্দাদেরকে বিপথগামী করতে শুরু করেছে এবং পরিবর্তন করে
দিচ্ছে আল্লাহর দীনকে। আর ইসলামের নামে নির্লজ্জ ও মনুষত্বহীনভাবে আল্লাহর
কিতাবকে পরিবর্তন করছে এবং সঠিক ইসলামী জীবনবিধানের নামে ছড়িয়ে দিচ্ছে
অবিশ্বাস, নাস্তিকতা, অন্যায় ও অবিচার।
আর এই ফিতনাসমূহের
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও নিকৃষ্টতর দিক হল রাফেযী ও শিয়া ফিতনা; এর দ্বারা তারা
আহলে বাইত তথা নবী পরিবার ও ইমামদের প্রতি ভালবাসার গান গেয়ে মূর্খ ও
নির্বোধ লোকদেরকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর তার অনুসারীগণ তা প্রচলন ও
সম্প্রসারণের জন্য ভয়ানক পদ্ধতি অবলম্বন করেছে এবং তাদের এই উদ্দেশ্য
বাস্তবায়নের জন্য তারা সকল আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শুরু করেছে এবং
তার জন্য তারা সকল প্রকার মূল্যবান ও দামী বস্তু ব্যয় করছে; আর এর জন্য
যাবতীয় ষড়যন্ত্র ও কুটবুদ্ধির অবতারণা করছে। হে আল্লাহ! আমরা তোমাকে তাদের ঘাঁড়ে রাখছি এবং তাদের অনিষ্ট থেকে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
আর মুসলিম দা‘য়ী
(আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী), বক্তা, সংস্কারক ও সকল আলেমের উপর ওয়াজিব
(আবশ্যক) হল এই নিকৃষ্ট ফিতনার আসল চেহারা উম্মোচন করে দেয়া এবং জনগণের
নিকট তার বিপথগামীতা ও অসারতা তুলে ধরা, যাতে তারা তাদের ঈমান ও আকিদাকে
হেফাযত করতে পারে।
হে ইসলামের
অনুসারী আলেমগণ! হে মুসলিমদের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ! আজকের দিনে অন্যতম
আবশ্যক কাজ হল, তোমাদের সর্বশক্তি দিয়ে সত্যকে বিজয় করা, বাতিলকে বিতাড়িত
করা এবং এই ফিতনাকে দূর করা। কেননা প্রাথমিকভাবে দায়িত্ব তো তোমাদের উপরই
বর্তায়, সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আল্লাহকে আরও ভয় কর তোমাদের
নিজেদের ব্যাপারে এবং ঐসব মুসলিমদের ব্যাপারে, বাতিল যাদের মধ্যে তার
ফিতনার বিষ ছড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং যাদের মধ্যে বাতিল তার
(তথাকথিত!) বিপ্লবের আমদানী ঘটিয়েছে। ফলে ঐসব সহজ সরল লোকদের আকিদাকে হক থেকে বাতিলে রূপান্তরিত করছে।
ওহে! আমি কি পৌঁছাতে পেরেছি.. হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক...।
প্রকাশ থাকে যে,
শিয়া ফিতনার সূচনা হয়েছে ইসলাম ও মুসলিমের শত্রু আবদুল্লাহ ইবন সাবা ইহুদী ও
তার অনুসারী যুরারা, আবূ বসীর, আবদুল্লাহ ইবন ই‘য়াফুর, আবূ মিখনাফ লূত ইবন
ইয়াহইয়া প্রমুখ মিথ্যাবাদীদের চেষ্টা-সাধনার দ্বারা; তাদের সার্বিক
প্রচেষ্টা হচ্ছে, যাতে তারা এর মাধ্যমে ইসলামের প্রকৃতরূপকে নিশ্চিহ্ন করে
দিতে পারে এবং মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ সারিকে ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করতে পারে ।
আর তারা এই শিয়া
আকিদাসমূহকে তাদের পক্ষ থেকে মিথ্যা অপবাদের মাধ্যমে সম্পর্কিত করেছে
আমাদের নেতা আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও তাঁর পবিত্র পরিবার-পরিজনের প্রতি;
অথচ তাঁরা সকলেই এর থেকে মুক্ত। কারণ, আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও তাঁর
পরিবার-পরিজন সকলেই ছিলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত।
আলী রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু এবং জাফর সাদিক পর্যন্ত তাঁর পরিবার-পরিজনের সকলেই মদীনা মুনাওয়ারায়
ঈমান, ইসলাম, কিতাব ও সুন্নাহ’র পরিবেশে জীবনযাপন করেছেন। আর তাঁদের ইবাদত ও
যাবতীয় আমল-আখলাক ছিল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্যান্য সকলের আমল-আখলাকের মত।
যখন জিজ্ঞাসা করা হয় যে, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর বংশধরগণ ছিলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের
অন্তর্ভুক্ত; তাঁরা আমল করতেন তাদের (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের) আমলের
মত ... এবং তাঁদের গোটা জীবন ছিল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের জীবনের মত? তখন তারা জবাব দেয় যে, নিশ্চয় তাঁরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসরণ করতেন ‘তাকিয়া’ (التقية)[3] –এর
পথ অনুসরণ করে। তারা রাত ও দিনের মধ্যে এক ঘন্টা বাছাই করে সেই সময়ের
মধ্যে তাদের অনুসারীদের সাথে বসত এবং তাদেরকে শিয়া মাযহাবের তালীম
(প্রশিক্ষণ) দিত। তাদের এই জওয়াব শুনে একজন বিবেকবান ও ন্যায়পরায়ণ মুসলিম
ব্যক্তি হতভম্ব হয়ে যাওয়ার কথা। কারণ, যদি আমরা তাদের কথা মেনে নেই, তবে
তার থেকে এটা আবশ্যক হয় যে, ইমামগণ রাতে ও দিনে তেইশ ঘন্টা (তাদের কথা
অনুযায়ী) বাতিলের উপর এবং এক ঘন্টা হকের উপর জীবন যাপন করেছে। আর এটা আলী
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও তাঁর পরিবার-পরিজনের উপর শিয়াদের পক্ষ থেকে ডাহা
মিথ্যা অপবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। সুতরাং মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর লানত
(অভিশাপ)।
আমরা প্রথমে
মোটামুটিভাবে তাদের কতগুলো ভ্রান্ত আকিদা লিপিবদ্ধ করব, অতঃপর তাদের নিকট
নির্ভরযোগ্য তাদের গ্রন্থসমূহ ও তথ্যপঞ্জি থেকে রেফারেন্সসহ (তথ্যসূত্র
উল্লেখ করে) বিস্তারিত আলোচনা করব; যাতে স্পষ্ট হয়ে যায় তাদের কর্মপদ্ধতি
এবং জানা যায় তাদের পথভ্রষ্টতা ও গোমরাহী সম্পর্কে।
১. ইহুদী, খ্রিষ্টান ও সকল মুশরিকদের মত আল্লাহর সাথে শির্কের আকিদা (বিশ্বাস) পোষণ করা। (নাউযুবিল্লাহ)।
৩. বার
ইমামের নিষ্পাপ হওয়ার আকিদা পোষণ করা; যা সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খতমে নবুওয়তের আকিদার পরিপন্থী।
৪. ‘কুরআন
বিকৃত ও পরিবর্তিত অবস্থায় মওজুদ রয়েছে এবং তাতে বেশি ও কম করা হয়েছে’ —
এমন আকিদা বিশ্বাস পোষণ করা। (নাউযুবিল্লাহ); আর এটা তাদের নোংরা ও
নিকৃষ্ট আকিদাসমূহের অন্যতম, যা তাদেরকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়া আবশ্যক
করে তোলে।
৫. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আলী, হাসান ও হোসাইন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম-দের অসম্মান করার আকিদা।
৬. মুমিন জননী, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুন্না-দের অসম্মান করার আকিদা।
৭. নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা, বিশেষ করে নারীদের নেত্রী ফাতিমা
যোহরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুন্না-দের অসম্মান করার আকিদা।
৮. আব্বাস, ইবনু আব্বাস ও ‘আকিল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম-দের অপমান করার আকিদা।
৯. খোলাফায়ে রাশেদীন, মুহাজির ও আনসার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম-দের অপমান করার আকিদা।
১০. আহলে বাইত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম তথা নবী পরিবার-পরিজনের মধ্যকার ইমামদের অপমান করার আকিদা।
১১. ‘তাকিয়া’ (التقية) –এর আকিদা।
১২. মুত‘আ বিয়ের (সাময়িক বিয়ে) আকিদা।
১৩. মহিলাদের যৌনাঙ্গ ধার করার (বেশ্যাবৃত্তি) বৈধতার আকিদা।
১৪. নারীদের সাথে সমকামিতা বৈধতার আকিদা।
১৫. রাজ‘আ (الرجعة) বা পুনর্জন্মের আকিদা।
১৬. মৃত্তিকার আকিদা।
১৭.
হোসাইনের শাহাদাতের স্মরণে মাতম, বক্ষ বিদীর্ণকরণ ও গালে আঘাত করার মধ্যে
সাওয়াব প্রত্যাশার আকিদা; যা বিপদে ধৈর্য অবলম্বন করার ইসলামী আকিদা
বিশ্বাসের পরিপন্থী।
মুহাম্মদ আবদুস সাত্তার আততুনসাবী
দারুল উলুমুল আরাবিয়্যা আল-ইসলামিয়্যাহ
হুলকম্ব, বরী, ব্রিটেন
তাদের ভ্রান্ত আকিদার প্রথম বিষয়
আল্লাহ সাথে শির্কের (অংশিদারীত্বের) আকিদা
মুহাম্মদ ইবন ইয়াকুব আল-কুলাইনী ‘উসুলুল কাফী’ গ্রন্থের মধ্যে “গোটা পৃথিবীর মালিক ইমাম” (باب أن الأرض كلها للإمام) নামক
অধ্যায়ে আবূ আবদিল্লাহ আ. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: দুনিয়া ও আখেরাত
ইমামের মালিকানায়, যেখানে ইচ্ছা তিনি তা রাখেন এবং আল্লাহর কাছ থেকে
পুরস্কারস্বরূপ যার কাছে ইচ্ছা তা হস্তান্তর করেন।[5]
সুতরাং একজন বিচক্ষণ মুসলিম এই বক্তব্য থেকে কী উদঘাটন করবেন; অথচ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সুস্পষ্ট আয়াতে বলেন:
﴿ إِنَّ ٱلۡأَرۡضَ لِلَّهِ يُورِثُهَا مَن يَشَآءُ ﴾ [سورة الأعراف: 128]
﴿ وَلِلَّهِ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ ﴾ [سورة آل عمران: 189]
﴿ فَلِلَّهِ ٱلۡأٓخِرَةُ وَٱلۡأُولَىٰ ٢٥ ﴾ [سورة النجم: 25]
﴿ لَهُ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ ﴾ [سورة الحديد: 2]
﴿ تَبَٰرَكَ ٱلَّذِي بِيَدِهِ ٱلۡمُلۡكُ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٌ ١﴾ [سورة الملك: 1]
আর শিয়াগণ লেখে: “আলী বলেন: ... আমিই প্রথম, আমিই শেষ, আমিই ব্যক্ত, আমিই উপরে আর আমিই নিকটে এবং আমিই যমিনের উত্তরাধিকারী”।[11]
আর এই আকিদাটিও
প্রথম আকিদার মত ভ্রান্ত। আর আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তা থেকে পবিত্র ও
মুক্ত; আর এটা তাঁর উপর একটা বড় ধরনের মিথ্যারোপ। তিনি এই ধরনের কথা বলতেই
পারেন না।
আর আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ هُوَ ٱلۡأَوَّلُ وَٱلۡأٓخِرُ وَٱلظَّٰهِرُ وَٱلۡبَاطِنُ ﴾ [سورة الحديد: 3]
﴿ وَلِلَّهِ مِيرَٰثُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ ﴾ [سورة الحديد: 10]
আর প্রসিদ্ধ শিয়া মুফাসসির মকবুল আহমদ সূরা যুমারের এই আয়াতের ব্যাখ্যা করেছে:
﴿ وَأَشۡرَقَتِ ٱلۡأَرۡضُ بِنُورِ رَبِّهَا ﴾ [سورة الزمر: 69]
“বিশ্ব তার প্রতিপালকের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হবে”। — (সূরা যুমার: ৬৯)
এই আয়াতের
ব্যাখ্যায় সে (মকবুল আহমদ) বলেছে, জাফর সাদিক বলেন: নিশ্চয় যমিনের রব
(মালিক) হলেন ইমাম। সুতরাং যখন ইমাম বের হবে, তখন তার আলোই যথেষ্ট; মানুষের
জন্য চন্দ্র ও সূর্যের প্রয়োজন হবে না।[14]
তোমরা চিন্তা করে দেখ, তারা কিভাবে ইমামকে ‘রব’ (প্রতিপালক) বানিয়েছে; এমনকি তারা "بنور ربها" (তার প্রতিপালকের জ্যোতিতে)-এর অর্থ বর্ণনায় বলে: ইমামই হলেন সেই রব এবং যমিনের মালিক।
অনুরূপভাবে সূরা যুমারের এই আয়াতের ব্যাখ্যায়:
﴿لَئِنۡ
أَشۡرَكۡتَ لَيَحۡبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٦٥
بَلِ ٱللَّهَ فَٱعۡبُدۡ وَكُن مِّنَ ٱلشَّٰكِرِينَ ٦٦﴾ [سورة الزمر: 65-66]
“তুমি আল্লাহর
শরিক স্থির করলে তোমার কর্ম তো নিষ্ফল হবে এবং অবশ্য তুমি হবে ক্ষতিগ্রস্ত।
অতএব তুমি আল্লাহরই ইবাদত কর এবং কৃতজ্ঞ হও।” — (সূরা যুমার: ৬৫-৬৬)
এই শিয়া মুফাসসির
(মকবুল আহমদ) জাফর সাদিক থেকে ‘কাফী’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন: তার (আয়াতের)
অর্থ হল: যদি তোমরা আলী’র বেলায়াতের (একচ্ছত্র কর্তৃত্ব বা অভিভাবকত্বের)
সাথে কাউকে শরিক কর, তবে তার ফলে তোমার আমল নিষ্ফল হবে।
অতঃপর ﴿ بَلِ ٱللَّهَ فَٱعۡبُدۡ وَكُن مِّنَ ٱلشَّٰكِرِينَ ٦٦﴾ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন: অর্থাৎ তোমরা আনুগত্যসহ নবীর ইবাদত কর এবং তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; কারণ, আমরা আপনার ভাই এবং চাচার ছেলেকে আপনার বাহুবলে পরিণত করেছি।[15]
লক্ষ্য কর, কিভাবে
তারা আয়াতের ব্যাখ্যায় জাফর সাদিকের উপর মিথ্যারোপ করে; অথচ এই আয়াতগুলোর
বক্তব্য হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ তথা একত্ববাদ প্রসঙ্গে; আর আল্লাহই
হলেন সকল কিছুর সৃষ্টা। আর সকল প্রকার ইবাদত তাঁর জন্য হওয়াই বাঞ্ছনীয়। [এ
আয়াত এগুলোই প্রমাণ হয়] কিভাবে তারা তা (আয়াত) বিকৃত করল এবং তার থেকে
সুস্পষ্ট শির্ককে বৈধতার প্রমাণ পেশ করল? আল্লাহ তাদেরকে উপযুক্ত এর শাস্তি
প্রদান করুন।
অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿ وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ ﴾ [سورة الذاريات: 56]
“আর আমি সৃষ্টি করেছি জিন ও মানুষকে এই জন্য যে, তারা কেবল আমারই ইবাদত করবে।” — (সূরা আয-যারিয়াত: ৫৬)-এর ব্যাখ্যায় এই শিয়া
মুফাসসির বলেন যে, জাফর সাদিক এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হুসাইন রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু’ থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তারা
তাকে চিনতে পারে। কারণ, তারা যখন তাকে চিনবে, তখন তারা তার ইবাদত করবে।
অতঃপর তাদের একজন তাকে জিজ্ঞাসা করল: চিনা-জানা বলতে কী বুঝায়? তখন সে জবাব
দিল: মানুষ তাদের যামানার ইমামকে চিনবে-জানবে।[16]
আর কুলাইনী
‘উসুলুল কাফী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ইমাম মুহাম্মদ বাকের বলেন: আমরা
আল্লাহর চেহারা; আমরা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে তার চোখ এবং তার হাত যা রহমতসহ
তার বান্দাদের উপর সম্প্রসারিত।[17]
অনুরূপভাবে সে বলে: আমরা আল্লাহর জিহ্বা; আমরা আল্লাহর চেহারা এবং আমরা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে তার চোখ।[18]
আর আবূ আবদিল্লাহ আ. (জাফর
সাদিক) থেকে বর্ণিত, আমীরুল মুমিনীন আ. বেশি বেশি বলতেন: জান্নাত ও
জাহান্নামের মধ্যে আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে বণ্টনকারী ... আমাকে এমন কতগুলো
বৈশিষ্ট্য দেয়া হয়েছে, যা আমার পূর্বে আর কাউকে দেয়া হয়নি; আমি জানি
মৃত্যু, বালা-মুসিবত, বংশ এবং বক্তৃতা-বিবৃতির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্পর্কে।
সুতরাং আমার পূর্বেকার কোন বিষয় আমার জানা থেকে বাদ পড়েনি এবং আমার নিকট
থেকে যা অদৃশ্য, তাও আমার কাছ থেকে অজানা থাকে না।[19]
তোমরা লক্ষ্য কর, কিভাবে তারা আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলীকে আলী’র জন্য সাব্যস্ত করার সাহস করল।
অনুরূপভাবে সূরা আল-কাসাসের
﴿كُلُّ شَيۡءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجۡهَهُ﴾ [سورة القصص: 88]
“তাঁর (আল্লাহর) চেহারা (সত্তা) ব্যতীত সব কিছুই ধ্বংসশীল”। — (সূরা আল-কাসাস: ৮৮)
এই আয়াতের
ব্যাখ্যায় শিয়া মুফাসসির মকবুল আহমদ বলেন, জাফর সাদিক তার ব্যাখ্যায় বলেন:
আমরা আল্লাহর (চেহারা) সত্তা। অতএব তোমরা লক্ষ্য কর, কিভাবে তারা ইমামকে
অবিনশ্বর ইলাহ বা মা‘বুদে পরিণত করেছে; অথচ যালিমগণ যা বলে, তার থেকে
আল্লাহ অনেক মহান, উচ্চ।
কুলাইনী তার গ্রন্থের কোন এক অধ্যায়ে উল্লেখ করেন: ইমামগণ যা হয়েছে এবং যা হবে, তার জ্ঞান রাখেন; আর তাদের নিকট কোন কিছুই গোপন নেই।
আবূ আবদিল্লাহ আ. (জাফর
সাদিক) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি অবশ্যই আসমান ও যমিনে যা কিছু আছে, তা
জানি এবং আমি আরও জানি জান্নাত ও জাহান্নামে যা কিছু আছে। আর যা হয়েছে এবং যা হবে, তাও আমি জানি।[20]
অনুরূপভাবে
‘উসুলুল কাফী’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে: “তারা (ইমামগণ) যা ইচ্ছা করে, তা হালাল
করতে পারে; আবার যা ইচ্ছা করে, তা হারামও করতে পারে। আর তারা কখনও কিছুর
ইচ্ছা করেন না, যতক্ষণ না মহান আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করেন।[21]
অথচ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ لِمَ تُحَرِّمُ مَآ أَحَلَّ ٱللَّهُ لَكَ ﴾ [سورة التحريم: 1]
“হে নবী! আল্লাহ যা তোমার জন্য হালাল করেছেন, তা তুমি কেন হারাম করলে”। — (সূরা তাহরীম: ১)
সুতরাং আল্লাহ যখন
তাঁর রাসূলকে হালাল জিনিসকে হারাম করার কারণে সতর্ক করে দিয়েছেন, তখন
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্যের দ্বারা তা কি করে সম্ভব
হতে পারে।
কুলাইনী তার
গ্রন্থের কোন এক অধ্যায়ে আরও উল্লেখ করেন: ইমামগণ জানেন যে, তারা কখন মারা
যাবেন; আর তারা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী মারা যাবেন। আবূ আবদিল্লাহ আ. বলেন:
কোন ইমাম যদি তার উপর আপতিত বিপদাপদ ও তার পরিণতি সম্পর্কে না জানে; তবে সে
ইমাম আল্লাহর সৃষ্টির ব্যাপারে দলিল (হিসেবে গ্রহণযোগ্য) নয়।[22] অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ قُل لَّا يَعۡلَمُ مَن فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ ٱلۡغَيۡبَ إِلَّا ٱللَّهُ﴾ [سورة النمل: 65]
“বল, আল্লাহ ব্যতীত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই অদৃশ্য বা গায়েবী বিষয়সমূহের জ্ঞান রাখে না”। — (সূরা আন-নমল: ৬৫) মহান আল্লাহ্ আরও বলেন,
﴿ وَعِندَهُۥ مَفَاتِحُ ٱلۡغَيۡبِ لَا يَعۡلَمُهَآ إِلَّا هُوَ ﴾ [سورة الأنعام: 59]
“আর অদৃশ্যের চাবিকাঠি তাঁরই নিকট রয়েছে, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা জনে না”। — (সূরা আল-আন‘আম: ৫৯)
কিন্তু শিয়াগণ তাদের ইমামদেরকে অদৃশ্যের জ্ঞানের ব্যাপারে আল্লাহর সাথে শরিক করে।
কুলাইনী তার
গ্রন্থের কোন এক অধ্যায়ে আরও উল্লেখ করেন: ইমামগণকে যদি গোপনে জিজ্ঞেস করা
হতো, তবে তারা প্রত্যেক মানুষের যাবতীয় কল্যাণ ও অকল্যাণ বলে দিত।
কুলাইনী ‘উসুলুল কাফী’ (এটা শিয়াদের মহাগ্রন্থ) গ্রন্থের “ইমামগণ ফেরেশতা, নবী ও রাসূলগণের নিকট প্রেরিত সকল জ্ঞান সম্পর্কে অবহিত” (باب أن الأئمة يعلمون جميع العلوم التي خرجت إلى الملائكة و الأنبياء و الرسل عليهم السلام ) নামক
অধ্যায়ে আরও উল্লেখ করেন: সামা‘আ থেকে বর্ণিত, সে আবূ আবদিল্লাহ আ. থেকে
বর্ণনা করেছেন, সে বলল: ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলার নিকট দুই ধরনের জ্ঞান
রয়েছে: এক প্রকারের জ্ঞান সম্পর্কে তাঁর ফেরেশতা, নবী ও রাসূলগণ অবহিত;
সুতরাং যে বিষয়ে তাঁর ফেরেশতা, নবী ও রাসূলগণ অবহিত, তা আমরা জানি। আরেক
প্রকার জ্ঞান হল যা একচেটিয়া তাঁর (আল্লাহর) নিজের জন্য; সুতরাং সেখান থেকে
কোন বিষয়ে যখন আল্লাহর বোধোদয় হয়, তখন তিনি তা আমাদেরকে জানিয়ে দেন এবং
আমাদের পূর্বে যেসব ইমাম ছিলেন, তাদের নিকট তা পেশ করেন।’ তোমরা লক্ষ্য কর,
তারা তাদের ইমামদেরকে তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী ফেরেশতা, নবী ও রাসূলগণের
চেয়ে বেশি জ্ঞানী মনে করে। আর জ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা তাদেরকে আল্লাহ
তা‘আলার অংশীদার মনে করে। এই সবগুলোই মিথ্যা, বানোয়াট ও কুফরী।
আর ‘উসুলুল কাফী’
এবং শিয়াদের অন্যান্য গ্রন্থসমূহ এই ধরণের মারাত্মক বিষয়াদি দ্বারা
পরিপূর্ণ। আমরা এখানে যা উল্লেখ করেছি, তা নিতান্তই কম। আর উর্দু ভাষায়
শিয়াদের অনেক কাব্য রয়েছে, যেগুলো আল্লাহর সাথে শির্ক এবং তাদের ইমামদের
নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি দ্বারা ভরপুর; তার কিছু অংশে বর্ণিত আছে যে, সকল
নবী বিপদ-মুসিবতের সময় আলী’র নিকট সাহায্য-সহযোগিতা চাইত; অতঃপর তিনি
তাদেরকে সাহায্য করতেন। সুতরাং নূহ আ. প্লাবনের সময় তার নিকট সাহায্য
চেয়েছেন; ইবরাহীম, লুত, হুদ ও শীস আ.-সহ সকলেই তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা
করেছেন এবং তিনি তাদের সাহায্য করেছেন। আর আলী’র মু‘জিযাসমূহ খুবই মহান,
বিস্ময়কর এবং প্রত্যেক বস্তুর উপর প্রভাবশালী (নাউযুবিল্লাহ)।
আর শিয়াদের নিকট
নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহ থেকে আমরা কয়েকটি বর্ণনা মাত্র এখানে লিপিবদ্ধ
করেছি। পাঠকদের জানা উচিত যে, তাদের গ্রন্থসমূহ এ ধরনের শির্ক মিশ্রিত
আকিদায় ভরপুর। সুতরাং এসব ভ্রান্ত আকিদায় বিশ্বাস করার পরও কোন ব্যক্তি
মুসলিম থাকতে পারে কি?
কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ ٱللَّهُ خَٰلِقُ كُلِّ شَيۡءٖۖ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ وَكِيلٞ ٦٢﴾ [سورة الزمر: 62]
“আল্লাহ সব কিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সকল কিছুর কর্মবিধায়ক”। — (সূরা যুমার: ৬২)
তিনি আরও বলেন:
﴿ وَلَا يُشۡرِكُ فِي حُكۡمِهِۦٓ أَحَدٗا ٢٦ ﴾ [سورة الكهف: 26]
“তিনি কাউকেও নিজ কর্তৃত্বে শরিক করেন না”। — (সূরা আল-কাহফ: ২৬)
তিনি আরও বলেন:
﴿ ٱللَّهُ
لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡحَيُّ ٱلۡقَيُّومُۚ لَا تَأۡخُذُهُۥ سِنَةٞ
وَلَا نَوۡمٞۚ لَّهُۥ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلۡأَرۡضِ ﴾ [سورة البقرة: 255]
“আল্লাহ,
তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তিনি চিরঞ্জীব, সর্বসত্তার ধারক। তাঁকে তন্দ্রা
অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না। আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সমস্ত তাঁরই।” —
(সূরা আল-বাকারা: ২৫৫)
তিনি আরও বলেন:
﴿وَلَقَدۡ
أُوحِيَ إِلَيۡكَ وَإِلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكَ لَئِنۡ أَشۡرَكۡتَ
لَيَحۡبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٦٥﴾ [سورة الزمر: 65]
“তোমার প্রতি ও
তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবশ্যই ওহী হয়েছে, তুমি আল্লাহর শরিক স্থির করলে
তোমার কর্ম তো নিষ্ফল হবে এবং অবশ্য তুমি হবে ক্ষতিগ্রস্ত।” — (সূরা
যুমার: ৬৫)
তিনি আরও বলেন:
﴿إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُ﴾ [سورة النساء: 116]
“নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরিক করাকে ক্ষমা করেন না; এটা ব্যতীত সব কিছু যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন”। — (সূরা আন-নিসা: ১১৬)
তিনি আরও বলেন:
﴿ إِنَّهُۥ مَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَقَدۡ حَرَّمَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِ ٱلۡجَنَّةَ وَمَأۡوَىٰهُ ٱلنَّارُ﴾ [سورة المائدة: 72]
“কেউ আল্লাহর সাথে শরিক করলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত অবশ্যই নিষিদ্ধ করবেন এবং তার আবাস জাহান্নাম”। — (সূরা আল-মায়িদা: ৭২)
তিনি আরও বলেন:
﴿ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَخۡفَىٰ عَلَيۡهِ شَيۡءٞ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَلَا فِي ٱلسَّمَآءِ ٥ ﴾ [سورة آل عمران: 5]
“নিশ্চয় আল্লাহর নিকট আসমান ও যমিনে কিছুই গোপন থাকে না”। — (সূরা আলে ইমরান: ৫)
সুতরাং এই আয়াত ও
অনুরূপ অন্যান্য আয়াত খুবই স্পষ্ট যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বস্তুর একক
স্রষ্টা এবং আসমান ও যমিনের ব্যবস্থাপক। আর তিনিই প্রত্যেক বস্তুর উপর
ক্ষমতাবান এবং তিনিই সব কিছুই জানেন।
পক্ষান্তরে শিয়াগণ
আল্লাহ্র গুণাবলীকে তাদের ইমামের জন্য সাব্যস্ত করেন; আর আল্লাহ্র
গুণাবলী আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য সাব্যস্ত করা কি শির্ক নয়?
আর যে ব্যক্তি এসব
গুণাবলী আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য সাব্যস্ত করাকে বৈধ বলে বিশ্বাস করে,
সে কি মুশরিক নয়? হ্যাঁ, অবশ্যই তা আল্লাহর গুণাবলীর মধ্যে শির্ক। আর এসব কথার প্রবক্তাগণ প্রকৃতই মুশরিক।
তাদের ভ্রান্ত আকিদার দ্বিতীয় বিষয়
البداء-(আল-বাদা)এর আকিদা
البداء শব্দের অর্থ গোপন থাকার পরে প্রকাশ হওয়া; [কুরআনুল কারীমে এ শব্দটি সৃষ্টির গুণ হিসেবে এসেছে, স্রষ্টার জন্য নয়] যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿ وَبَدَا لَهُم مِّنَ ٱللَّهِ مَا لَمۡ يَكُونُواْ يَحۡتَسِبُونَ ٤٧ ﴾ [سورة الزمر: 47]
“এবং তাদের (কাফেরদের) জন্য আল্লাহর নিকট থেকে এমন কিছু প্রকাশিত হবে, যা তারা কল্পনাও করেনি। —(সূরা আয-যুমার: ৪৭)
অথবা শব্দটির
অর্থ: নতুন রায় বা সিদ্ধান্তের উৎপত্তি যা পূর্বে ছিল না; [কুরআনুল কারীমে এ
শব্দটি সৃষ্টির গুণ হিসেবে এসেছে, স্রষ্টার জন্য নয়] যেমন আল্লাহ তা‘আলার
বাণী:
﴿ثُمَّ بَدَا لَهُم مِّنۢ بَعۡدِ مَا رَأَوُاْ ٱلۡأٓيَٰتِ لَيَسۡجُنُنَّهُۥ حَتَّىٰ حِينٖ ٣٥﴾ [سورة يوسف: 35]
“নিদর্শনাবলী দেখার পর তাদের [মিসর রাজের সভাসদদের] মনে হল যে, তাকে কিছু কালের জন্য কারারুদ্ধ করে রাখতে হবে।” — (সূরা ইউসূফ: ৩৫)
আর البداء (আল-বাদা) শব্দের
দু’টি অর্থই প্রথমে মূর্খতা এবং পরে জ্ঞান প্রকাশ বা হাসিল হওয়াকে আবশ্যক
করে তোলে; আর উভয়টিই আল্লাহর ক্ষেত্রে অসম্ভব। কারণ, আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞান
সর্বপ্রাচীন ও চিরস্থায়ী। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَعِندَهُۥ
مَفَاتِحُ ٱلۡغَيۡبِ لَا يَعۡلَمُهَآ إِلَّا هُوَۚ وَيَعۡلَمُ مَا فِي
ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِۚ وَمَا تَسۡقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلَّا يَعۡلَمُهَا
وَلَا حَبَّةٖ فِي ظُلُمَٰتِ ٱلۡأَرۡضِ وَلَا رَطۡبٖ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَٰبٖ مُّبِينٖ ٥٩ ﴾ [سورة النمل: 59]
“অদৃশ্যের
চাবিকাঠি তাঁরই নিকট রয়েছে, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা জানে না। জলে ও স্থলে
যা কিছু আছে, তা তিনিই অবগত; তাঁর অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও পড়ে না। মাটির
অন্ধকারে এমন কোন শস্যকণাও অঙ্কুরিত হয় না, আর রসযুক্ত কিংবা শুষ্ক এমন কোন
বস্তু নেই, যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই”। — (সূরা আল-আন‘আম: ৫৯)
আর শিয়াদের মতে, البداء তথা
অজানার পরে জানার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; যেমন তাদের
মৌলিক গ্রন্থসমূহ থেকে উদ্ধৃত নিম্নোক্ত বক্তব্যসমূহ তাই প্রমাণ করে:
মুহাম্মদ ইবন ইয়াকুব আল-কুলাইনী তার ‘উসুলুল কাফী’ গ্রন্থের মধ্যে البداء -এর বিষয়ে একটি পরিপূর্ণ অধ্যায়ের উল্লেখ করেছেন এবং তার নাম দিয়েছেন "باب البداء"; আর তাতে তিনি অনেকগুলো বর্ণনা নিয়ে এসেছেন। তার মধ্য থেকে কিছু বর্ণনা আমরা উল্লেখ করছি:
যুরারা ইবন আ‘ইউন থেকে বর্ণিত, তিনি (জাফর সাদেক অথবা মুসা কাযেম) তাদের একজন থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: البداء-এর
মত অন্য কোন কিছুকে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করে কেউ আল্লাহর ইবাদত করতে
পারে নি। [অর্থাৎ আল্লাহর জন্য ‘বাদা’ সাব্যস্ত করার মাধ্যমেই সবচেয়ে বড়
ইবাদাত সম্পন্ন হয়, নাউযুবিল্লাহ]
আর ইবনু আবি
উমাইয়েরের এক বর্ণনায় আছে, তিনি হিশাম ইবন সালেম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি
আবূ আবদিল্লাহ আ. থেকে বর্ণনা করেন: আল্লাহ তা‘আলাকে البداء- ‘বাদা’ সাব্যস্ত করার মত অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্মানিত করা হয় না।
আর মারাযেম ইবন
হাকিম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি আবূ আবদিল্লাহ আ.-কে বলতে শুনেছি:
আল্লাহর জন্য পাঁচটি বিষয়ের স্বীকৃতি দেয়ার পূর্বে কোন নবী ভবিষ্যদ্বাণী
করতে পারত না; সেগুলো হল: البداء বা (কোন গোপন কিছু প্রকাশ পাওয়া) المشيئة বা (ইচ্ছা) সিজদা, ইবাদত বা দাসত্ব এবং আনুগত্য।
রাইয়ান ইবন সালত
থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রেযা আ.-কে বলতে শুনেছি: আল্লাহ যত নবী প্রেরণ
করেছেন, তাদের প্রত্যেকেই মদকে নিষিদ্ধ করত এবং আল্লাহর জন্য البداء-এর স্বীকৃতি প্রদান করত।
কুলাইনী নিজেও
বলেন: আবূ জাফরের পরে আল্লাহর মনে হল আবূ মুহাম্মদের কথা, যা তিনি আগে
জানতেন না; যেমনিভাবে তাঁর মনে হল ইসমাঈল চলে যাওয়ার পর মূসার কথা[23],
যখন তার অবস্থা সম্পর্কে তিনি পরিষ্কার ধারণা পেলেন। আর তিনি (আল্লাহ)
হলেন তেমন, যেমন তোমার নিকট তোমার মনে যা উদয় হয়; যদিও বাতিলগণ তা অপছন্দ
করুক। আর আবূ মুহাম্মদ আমার ছেলে এবং আমার পরবর্তী বংশধর। তার নিকট
প্রয়োজনীয় জ্ঞান রয়েছে এবং তার সাথে রয়েছে ইমামতের উপকরণ।[24] আর
এভাবেই শি‘আরা আল্লাহর উপর ও তাদের ইমামদের উপর মিথ্যারোপ করে; তারা
আল্লাহর ব্যাপারে অন্যায়ভাবে জাহেলী ধারণা পোষণ করে। আর তারা দাবি করে যে,
আল্লাহ আবূ জাফর (মুহাম্মাদ ইবন আলী)কে ইমাম বানানোর ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন;
অতঃপর সে যখন ইমাম হওয়ার পূর্বেই মারা গেল, তখন মহান ক্ষমতাধর আল্লাহর মনে
হল যে, ইমাম হবে আবূ মুহাম্মদ; অতঃপর তিনি তাই করলেন। আর এটা অনুরূপ যে,
আল্লাহ চেয়েছিলেন ইসমাঈলকে ইমাম বানাতে, অতঃপর (নাউযুবিল্লাহ) আল্লাহর কাছে
নতুন কিছু প্রকাশ পেল; তখন তিনি পূর্ববর্তী রায়কে পরিবর্তন করেছেন এবং
মূসা আল-কাযেমকে মানুষের ইমাম বানিয়েছেন। আর এভাবেই তারা তাদের প্রবৃত্তির
অনুসরণ করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র উপর মিথ্যারোপ করেছে। সুতরাং তারা যা বলে, তার কারণে তাদের ধ্বংস অনিবার্য।
তারা ভুলে গেছে
-আল্লাহ যে তাদেরকে অভিশাপ দিন- তাদের এই মিথ্যা বক্তব্যসমূহের ফলে আল্লাহ
তা‘আলার প্রতি অজ্ঞতার সম্পর্ক আবশ্যক হয়ে পড়ে; আর তা স্পষ্ট কুফরী।
আর কুলাইনী আবূ
হামযা আস-সুমালী থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আমি আবূ জাফর আ.-কে বলতে
শুনেছি: হে সাবিত! নিশ্চয় আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা এই বিষয়ের (মাহাদী
আগমনের) সময় নির্ধারণ করেছেন সত্তর বছরের মধ্যে। অতঃপর যখন হোসাইন আ. নিহত
হলেন, তখন জগতবাসীর উপর আল্লাহর প্রচণ্ড রাগ হয় এবং তার আগমনের সময়কাল একশত
চল্লিশ[25] বছরে
পিছিয়ে দেন। অতঃপর আমরা তোমাদের নিকট তার বর্ণনা দিলাম এবং তোমরাও এই ঘটনা
প্রচার করে দিলে। সুতরাং তোমরা গোপন বিষয় স্পষ্ট করে দিলে; আর আল্লাহ
তা‘আলা এর পরে আমাদের জানা মতে তার আগমনের কোন সময় নির্ধারণ করেন
নি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ يَمۡحُواْ ٱللَّهُ مَا يَشَآءُ وَيُثۡبِتُۖ وَعِندَهُۥٓ أُمُّ ٱلۡكِتَٰبِ ٣٩﴾ [سورة الرعد: 39]
“আল্লাহ
যা ইচ্ছা তা নিশ্চিহ্ন করেন এবং যা ইচ্ছা তা প্রতিষ্ঠিত রাখেন; আর তাঁরই
নিকট রয়েছে উম্মুল কিতাব।” —(সূরা আর-রা‘দ: ৩৯) আবূ হামযা বলেন: আমি এই
ঘটনাটি আবূ আবদিল্লাহ আ.-এর নিকট বর্ণনা করলাম; তখন তিনি বললেন: বিষয়টি এই
রকমই ছিল।[26]
আর তার কথায় ‘এই বিষয় দ্বারা’ (بهذا الأمر) উদ্দেশ্য হল, ইমাম মাহদী’র আত্মপ্রকাশ। অতঃপর তাদের এই সকল কথা এবং দাবিসমূহ সুস্পষ্ট ভ্রান্ত দাবি ও অসার। কারণ, البداء-এর
আকিদা (নাউযুবিল্লাহ) এই কথা আবশ্যক করে তোলে যে, আল্লাহ তা‘আলার অবস্থা
হল এমন, এসব বিষয় তিনি জানতেন না, যেগুলো পরবর্তীতে এসেছে। অতঃপর যখন তা
প্রকাশ পেল এবং আল্লাহ তা‘আলা তা জানতে পারলেন, তখন তিনি তাঁর পুরাতন রায়কে
পরিবর্তন করলেন এবং নতুন প্রেক্ষাপট ও অবস্থার আলোকে নতুর রায় বা
সিদ্ধান্ত প্রস্তুত করলেন। অথচ আল্লাহ তা‘আলার প্রতি অজ্ঞতার সম্পর্ক জুড়ে দেয়াটা স্পষ্ট কুফরী, যা যথাস্হানে আলোচিত হয়েছে।
তাদের ভ্রান্ত আকিদার তৃতীয় বিষয়
দ্বাদশ ইমাম নিষ্পাপ
মুহাম্মদ ইবন ইয়াকুব আল-কুলাইনী তার ‘উসুলুল কাফী’ গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখ করেছেন:
আবূ আবদিল্লাহ আ.
থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আলী আ. যা কিছু নিয়ে এসেছেন, তা তিনি গ্রহণ করব
এবং যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা থেকে তিনি বিরত থাকব। তিনি
(আলী) মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মত মর্যাদাসম্পন্ন। আর
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা আল্লাহর সকল সৃষ্টির
উপর স্বীকৃত। কেউ
আলীর কথার উপর কথা বলা যেন আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর কথা বলা। আর আলীর কোন
কথার বিরুদ্ধাচারণ করা আল্লাহর সাথে শির্ক করার পর্যায়ে।...... অনুরূপভাবে এ বিধান বহাল থাকবে ক্রমান্বয়ে আগত হেদায়াতের ইমামদের বেলায়ও[27];
আল্লাহ তাদেরকে যমিনের খুঁটি বানিয়েছেন, যাতে যমিন তার অধিবাসীদের নিয়ে
স্থিতিশীল থাকতে পারে এবং যমিনের উপরে ও নীচে যারা আছেন, তাদের জন্য তাঁর
পরিপূর্ণ দলিল বানিয়েছেন। আর আমীরুল মুমিনীন আ. বেশি বেশি বলতেন: জান্নাত ও
জাহান্নামের মধ্যে আমি আল্লাহর বণ্টনকারী; আমি সত্য-মিথ্যার বড়
পার্থক্যকারী; আমি লাঠি ও লৌহযন্ত্রের অধিকারী। আর আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে
সকল ফেরেশতা, জিবরাঈল এবং রাসূলগণ, যেমনিভাবে তারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আর আমি তার (দায়িত্বের) বোঝার মতই
বোঝা বহন করেছি; আর সেই বোঝাটি হল রব তথা প্রতিপালকের বোঝা।[28]
কুলাইনী আরও
উল্লেখ করেন, ইমাম জাফর সাদিক বলেন: আমরা আল্লাহর জ্ঞানভাণ্ডার; আমরা
আল্লাহর আদেশের ব্যাখ্যা; আমরা নিষ্পাপ জাতি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের আনুগত্য
করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে নিষেধ করেছেন। আমরা
আসমানের নীচে এবং যমিনের উপরে আল্লাহর পরিপূর্ণ দলিল।[29]
কুলাইনী আরও
উল্লেখ করেন যে, আমি আবূ আবদিল্লাহ আ.-কে বলতে শুনেছি: ইমামগণ রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমান মর্যাদা সম্পন্ন; কিন্তু তারা নবী
নন। আর তাদের জন্য বেশী নারী বিয়ে করা বৈধ নয়, যেমনিভাবে নবীর জন্য বৈধ ছিল। সুতরাং এটা ছাড়া তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমান মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব।[30]
কুলাইনী "باب ما نص الله عز و جل و رسوله على الأئمة عليهم السلام واحدا فواحدا" (এক এক করে ইমাম আ.-দের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের বক্তব্যের অধ্যায়)-এ উল্লেখ করেন: আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿ ٱلنَّبِيُّ
أَوۡلَىٰ بِٱلۡمُؤۡمِنِينَ مِنۡ أَنفُسِهِمۡۖ وَأَزۡوَٰجُهُۥٓ
أُمَّهَٰتُهُمۡۗ وَأُوْلُواْ ٱلۡأَرۡحَامِ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلَىٰ بِبَعۡضٖ فِي كِتَٰبِ ٱللَّهِ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُهَٰجِرِينَ﴾[سورةالأحزاب:6]
“নবী
মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর এবং তার স্ত্রীগণ তাদের
মাতা। আল্লাহর বিধান অনুসারে মুমিন ও মুহাজির অপেক্ষা— যারা আত্মীয় তারা
পরস্পরের নিকটতর।” — (সূরা আল-আহযাব: ৬); —প্রসঙ্গে আবূ জাফর আ. থেকে
বর্ণিত যে, জিজ্ঞাসা করা হল, কাদের ব্যাপারে এই আয়াত নাযিল হয়েছে? তখন তিনি
বললেন: এই আয়াত নাযিল হয়েছে আমীর বা ইমামদের ব্যাপারে; এই আয়াতটি হোসাইন
আ.-এর পরে তার সন্তানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সুতরাং আমরা ইমামত, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবার-পরিজনের ব্যাপারে মুমিন,
মুহাজির ও আনসারদের চেয়ে ঘনিষ্ঠতর। আমি বললাম, এর মধ্যে জাফরের সন্তানদের[31] কোন অংশ আছে কি?[32] তিনি
বললেন: না; অতঃপর আমি বললাম: এর মধ্যে আব্বাসের সন্তানদের কোন অংশ আছে কি?
তিনি বললেন: না; অতঃপর আমি বনী আবদুল মুত্তালিবের মধ্যকার একজন একজন করে
তার নিকট জিজ্ঞাসা করলাম, এর মধ্যে তাদের কোন অংশ আছে কিনা? তিনি
প্রত্যেকের ব্যাপারে না বললেন। আর আমি হাসান আ.-এর সন্তানের কথা ভুলে গেছি;
অতঃপর তার নিকট আবার হাজির হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম: হাসানের সন্তানের জন্য এর
মধ্যে কোন অংশ আছে কি? তিনি বললেন: না[33], আল্লাহর শপথ করে বলছি হে আবদুর রহীম! এর মধ্যে আমরা ব্যতীত কোন মুহাম্মদী’র জন্য কোন অংশ নেই।[34]
ইমামদের আনুগত্য ফরয হওয়ার অধ্যায়[35]:
আবূ সাবাহ থেকে
বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি আবূ আবদিল্লাহ আ.-কে বলতে
শুনেছি: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আলী ইমাম; আল্লাহ তার আনুগত্য করাকে ফরয
করে দিয়েছেন। আর নিশ্চয় হাসান ইমাম; আল্লাহ তার আনুগত্য করাকে ফরয করে
দিয়েছেন এবং হোসাইনও ইমাম; আল্লাহ তার আনুগত্য করাকে ফরয করে দিয়েছেন। আর
আলী ইবন হোসাইন ইমাম; আল্লাহ তার আনুগত্য করাকে ফরয করে দিয়েছেন এবং
মুহাম্মদ ইবন আলীও ইমাম; আল্লাহ তার আনুগত্য করাকে ফরয করে দিয়েছেন।[36]
কুলাইনী আরও উল্লেখ করেন, ইমাম মুহাম্মদ বাকের বলেন: আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে কদরের রাতসমূহে নবী এবং অসী[37]দের নিকট নির্দেশ আসত যে, এটা কর; আর এই নির্দেশটি তারা ভালভাবেই শিখেছিল, কিভাবে তারা তা কার্যে পরিণত করবে।[38]
শিয়াগণ তাদের
নিজেদের মনগড়া মতে ইমামতের (নেতৃত্বের) অর্থ আবিষ্কার করেছে; এমনকি তারা
ইমামকে আল্লাহর নবীদের মত নিষ্পাপ মনে করে এবং তারা তাকে অদৃশ্যজগতের
জ্ঞানের অধিকারী মনে করে। আর তারা তাদের এই লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের জন্য
অসংখ্য মিথ্যা ও বানোয়াট বর্ণনা উপস্থাপন করে। অথচ বাস্তব ও সত্য কথা
হচ্ছে, অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। আর এই শব্দটি মুমিন ও কাফির উভয়ের ক্ষেত্রেই
প্রযোজ্য। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامٗا﴾ [سورة البقرة: 124]
“আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা বানাচ্ছি” —(সূরা আল-বাকারা: ১২৪)
﴿رَبَّنَا هَبۡ لَنَا مِنۡ أَزۡوَٰجِنَا وَذُرِّيَّٰتِنَا قُرَّةَ أَعۡيُنٖ وَٱجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِينَ إِمَامًا ٧٤ ﴾ [سورة الفرقان: 74]
“হে
আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান কর, যারা
হবে আমাদের জন্য নয়নপ্রীতিকর এবং আমাদেরকে কর মুত্তাকীদের জন্য
অনুসরণযোগ্য” — (সূরা আল-ফুরকান: ৭৪)
আর কাফিরের ক্ষেত্রে ‘ইমাম’ শব্দের ব্যবহারে যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿ فَقَٰتِلُوٓاْ أَئِمَّةَ ٱلۡكُفۡرِ ﴾ [سورة التوبة: 12]
“তবে কাফিরদের প্রধানদের সাথে যুদ্ধ কর” — (সূরা আত-তাওবা: ১২)
﴿وَجَعَلۡنَٰهُمۡ أَئِمَّةٗ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلنَّارِ﴾ [سورة القصص: 41]
“আর আমি তাদেরেকে নেতা বানিয়েছিলাম; তারা জনগণকে জাহান্নামের দিকে আহ্বান করত”। — (সূরা আল-কাসাস: ৪১)
সুতরাং এই ইমাম শব্দটি নিষ্পাপ হওয়া, অদৃশ্যজগতের জ্ঞান
রাখা এবং বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা থাকতে হবে এমনটি দাবি করে
না। আর তাদের নিকট শরীয়তের এমন কোন প্রমাণ নেই, যার দ্বারা তারা ইমামের
জন্য যেসব গুণাবলী নির্ধারণ করেছে, তা প্রমাণ করতে পারে। তবে হ্যাঁ,
আল্লাহর কিতাব চারটি স্তর বিন্যাস করেছে; যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿ وَمَن
يُطِعِ ٱللَّهَ وَٱلرَّسُولَ فَأُوْلَٰٓئِكَ مَعَ ٱلَّذِينَ أَنۡعَمَ
ٱللَّهُ عَلَيۡهِم مِّنَ ٱلنَّبِيِّۧنَ وَٱلصِّدِّيقِينَ وَٱلشُّهَدَآءِ
وَٱلصَّٰلِحِينَۚ وَحَسُنَ أُوْلَٰٓئِكَ رَفِيقٗا ٦٩﴾ [سورة النساء: 69]
“আর
কেউ আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য করলে সে নবী, সত্যনিষ্ঠ, শহীদ ও
সৎকর্মপরায়ণ— যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন— তাদের সঙ্গী হবে এবং তারা
কত উত্তম সঙ্গী!” — (সূরা আন-নিসা: ৬৯)
সুতরাং এই চার
স্তরের মধ্যে ইমামতের পদ নেই, যা শিয়াগণ আবিষ্কার করেছে এবং তাদের মাযহাবের
ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অথচ আলী ও তাঁর পরিবার-পরিজন
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম (তার আনুগত্য করা ফরয অথবা সে নিষ্পাপ) এই অর্থে ইমাম
হওয়ার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। কারণ, ওসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র শাহাদাতের
পর যখন জনগণ আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র হাতে আনুগত্যের শপথ নিতে চাইল এবং
তারা বলল, আপনি আপনার হাত প্রসারিত করুন, আমরা আপনার নিকট আপনার খেলাফতের
অধীনে থাকার জন্য আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করব; তখন তিনি বললেন: তোমরা আমাকে
মাফ কর (মুক্তি দাও) এবং আমি ভিন্ন অন্য একজনকে খোঁজ করে বের কর; আর তোমরা
যদি আমাকে রুখসত দাও, তবে আমি তোমাদের মত একজন হব এবং তোমরা যাকে তোমাদের
শাসনক্ষমতা দান করবে, আমি আলী তোমাদের চেয়ে বেশি তার কথা শুনব এবং তার
আনুগত্য করব; আর আমার চেয়ে তোমাদের ভাল আমীরের জন্য আমি হব উত্তম
সাহায্যকারী।[39]
আর এই বক্তব্যটি নাহজুল বালাগাহ (نهج البلاغة)-এর মধ্যে উদ্ধৃত; আর এই গ্রন্থটি শিয়াদের গ্রন্থসমূহের মধ্যে অন্যতম, যার উপর তারা নির্ভর করে থাকে।(?)
সুতরাং তার ইমামত
(নেতৃত্ব) যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত হত, তা হলে তিনি এই ধরনের ওযর
পেশ করতেন না। কারণ, আল্লাহর পক্ষ থেকে ইমামতের দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেয়া
হলে[40] তার
আনুগত্য করা ইমাম ও প্রজাসাধারণ সবার উপরই ওয়াজিব। অনুরূপভাবে হাসান
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁর ইমামত (নেতৃত্ব)-কে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র
নিকট অর্পণ করেছেন এবং তাঁর হাতে আনুগত্যের শপথ করেছেন। অনুরূপভাবে হোসাইন
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুও মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র হাতে আনুগত্যের শপথ
করেছেন।[41]
সুতরাং হাসান ও
হোসাইন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা যদি আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নির্দেশনার
দ্বারা ইমাম হতেন, তবে তাঁরা মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র হাতে আনুগত্যের
শপথ করতেন না এবং তাঁর নিকট ক্ষমতার বিষয়টি অর্পণ করতেন না।
আর খলীফা মামুনুর
রশিদ আলী রেযা র.-কে বলেন: আমি চাই আমি নিজেকে খেলাফতের দায়িত্ব থেকে
সরিয়ে নিব এবং সে পদে আপনাকে নিয়োগ দিব; আর আমি আপনার নিকট আনুগত্যের শপথ
নিব। তখন তিনি বললেন, আমি স্বেচ্ছায় কখনও এই কাজ করব না।
সুতরাং এটাও
প্রমাণ করে যে, ইমাম আলী রেযা র. ইমামত তথা নেতৃত্ব গ্রহণ করেন নি। অতএব,
ইমামত (আল্লাহর পক্ষ থেকে) নির্দেশিত কোন ফরয বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়, যার
কারণে রাফেযী ও শিয়াগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণকে কাফির বলে আখ্যায়িত করেছে; যে বিষয়ে অচিরেই আলোচনা আসছে ইনশাআল্লাহ।
আর
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যেসব গুণাবলী আমরা বিশ্বাস
করে থাকি, সেগুলো আল-কুরআন ও হাদিসে নববীর বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত; সুতরাং
আল-কুরআন সুস্পষ্ট ভাষায় বলে:
﴿ وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا رَحۡمَةٗ لِّلۡعَٰلَمِينَ ١٠٧ ﴾ [سورة الأنبياء: 107]
“আমি তো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।” — (সূরা আল-আম্বিয়া: ১০৭)
﴿ وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا كَآفَّةٗ لِّلنَّاسِ بَشِيرٗا وَنَذِيرٗا ﴾ [سورة سبا: 28]
“আমি তো তোমাকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।” — (সূরা সাবা: ২৮)
﴿ قُلۡ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنِّي رَسُولُ ٱللَّهِ إِلَيۡكُمۡ جَمِيعًا ﴾ [سورة الأعراف: 158]
“বল, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রাসূল”। — (সূরা আল-আ‘রাফ: ১৫৮)
﴿ تَبَارَكَ ٱلَّذِي نَزَّلَ ٱلۡفُرۡقَانَ عَلَىٰ عَبۡدِهِۦ لِيَكُونَ لِلۡعَٰلَمِينَ نَذِيرًا ١﴾ [سورة الفرقان: 1]
“কত বরকতময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফুরকান অবতীর্ণ করেছেন; যাতে সে সৃষ্টিকুলের জন্য সতর্ককারী হতে পারে”। — (সূরা আল-ফুরকান: ১৫৮)
﴿ فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥﴾ [سورة النساء: 65]
“কিন্তু
না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের
নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার তোমার উপর অর্পণ না করে; অতঃপর তোমার
সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে তা
মেনে না নেয়”। — (সূরা আন-নিসা: ৬৫)
﴿ وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْ ﴾ [سورة الحشر: 7]
“রাসূল তোমাদেরকে যা দেয়, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করে, তা থেকে তোমরা বিরত থাক”। — (সূরা আল-হাশর: ৭)
﴿ قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ ﴾ [سورة آل عمران: 31]
“বল, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন”। — (সূরা আলে ইমরান: ৩১)
﴿ مَّن يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدۡ أَطَاعَ ٱللَّهَ﴾ [سورة النساء: 80]
“কেউ রাসূলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল”। — (সূরা আন-নিসা: ৮০)
﴿ وَمَن
يُشَاقِقِ ٱلرَّسُولَ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ ٱلۡهُدَىٰ
وَيَتَّبِعۡ غَيۡرَ سَبِيلِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ نُوَلِّهِۦ مَا تَوَلَّىٰ
وَنُصۡلِهِۦ جَهَنَّمَۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ١١٥ ﴾ [سورة النساء: 115]
“কারো
নিকট সৎপথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের
পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যে দিকে সে ফিরে যায় সে দিকেই তাকে
ফিরায়ে দেব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব; আর তা কত মন্দ আবাস!” — (সূরা
আন-নিসা: ১১৫)
আর ইমামগণ ঐক্যমত
পোষণ করেছেন যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর
সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এবং তাদের মধ্যে সব চেয়ে বেশি সম্মানিত। আর তাঁর রয়েছে
সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ স্থান; যাঁর গুণাবলী ও মান-মর্যাদার ধারে কাছেও কোন
সৃষ্টি পৌঁছাতে পারবে না; আর তিনি হলেন নিষ্পাপ, অনুসরণীয় এবং সর্বশেষ নবী।
আর তাঁর খলিফাগণ তাঁর যথাযথ আনুগত্য করেছেন এবং অনুকরণ করেছেন তাঁর
পদাঙ্ক। আর তাঁরা ছোট ও বড় প্রতিটি বিষয়ে তাঁর অনুসরণ করতেন। আর তাঁরা
ছিলেন তাকওয়ার অনুসারী এবং মহান মর্যাদার অধিকারী; কিন্তু তাঁরা নিজেদেরকে
নিষ্পাপ হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর শরিক মনে করতেন না এবং মর্যাদা ও কামালিয়াতের
(পরিপূর্ণতার) ক্ষেত্রে তাঁকে নিজেদের সমান মনে করতেন না; যেমনিভাবে শিয়াগণ
তাদের ইমামদের ব্যাপারে মিথ্যারোপ করে থাকে।
তাদের ভ্রান্ত আকিদার চতুর্থ বিষয়
বর্তমানে বিদ্যমান কুরআন বিকৃত ও পরিবর্তিত
শিয়াগণ মুসলিমদের নিকট বর্তমানে বিদ্যমান কুরআনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না তিন কারণে:
প্রথম কারণ:
শিয়াদের আকিদা (বিশ্বাস) অনুযায়ী সাহাবীগণ সকলেই মিথ্যাবাদী।
“আর তারা বিশ্বাস করে মিথ্যা বলা ইবাদত”।
অনুরূপভাবে আহলে বাইত তথা নবী পরিবারের ইমামগণ মিথ্যাবাদী এবং ‘তাকীয়া’-র অনুসারী।
“আর তারা বিশ্বাস করে মিথ্যা বলা ইবাদত”।
সুতরাং যখন সকল সাহাবী ও আহলে বাইত তথা নবী পরিবারের ইমামগণ মিথ্যাবাদী হয়ে যায়, তখন তারা কারা, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে এই কুরআন মাজীদ যথাযথভাবে পৌঁছাবে?
দ্বিতীয় কারণ:
অনুরূপভাবে শিয়াদের আকিদা (বিশ্বাস) অনুযায়ী সাহাবীগণ মিথ্যাবাদী ছিলেন। আর তারাই আল-কুরআনুল কারীম কপি করেছেন এবং বর্ণনা করেছেন।
আর আহলে বাইত তথা
নবী পরিবারের ইমামগণ তা বর্ণনা, সংকলন ও সত্যায়ন কোনটাই করেনি; সুতরাং
কিভাবে রাফেযী ও শিয়াগণ বিদ্যমান এই কুরআনের বিশুদ্ধতা ও পরিপূর্ণতার
ব্যাপারে আস্থা পোষণ করবে?
তৃতীয় কারণ:
শিয়াদের মত
অনুযায়ী তাদের নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহে বর্ণিত বিশুদ্ধ বর্ণনাসমূহ; যার
সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে গেছে (যা তাদের নিকট মুতাওয়াতির বর্ণনা বলে
বিবেচিত)। আর প্রত্যেকটি বর্ণনাই স্পষ্ট করে বলে যে, আমাদের নিকট বিদ্যমান
কুরআন বিকৃত, পরিবর্তিত এবং তার থেকে কম-বেশি করা হয়েছে; আর আমরা শিয়াদের
গ্রন্থসমূহের মধ্যে একটি বিশুদ্ধ বর্ণনাও পাব না, যা প্রমাণ করবে যে,
আমাদের নিকট বিদ্যমান কুরআন পরিপূর্ণ, অবিকৃত এবং অপরিবর্তিত। সুতরাং মনে
হয় যেন সাব্যস্ত হওয়ার দিক থেকে (আমাদের নিকট বিদ্যমান) কুরআন মাজীদের
অবস্থান শিয়াদের নিকট বিশুদ্ধ হাদিসের অবস্থানের চেয়েও অপূর্ণাঙ্গ।
আর শিয়ারা তাদের
আলেম শরীফ মুর্তযা, আবূ জাফর আত-তুসী, আবূ আলী আত-তাবারসী এবং শাইখ সাদুক এ
চার জন আলেমের বক্তব্য দ্বারা দলীল পেশ করে থাকে যে, তারা চারজন কুরআন
বিকৃত হওয়াকে অস্বীকার করেছেন[42]। বস্তুত শিয়াদের দ্বারা (কুরআন
বিকৃত না হওয়ার পক্ষে) ঐ চারজনের বক্তব্য পেশকরা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলক।
কারণ, শিয়া মাযহাবের গণ্ডি বা পরিধি তাদের নিষ্পাপ ইমামগণ ও অধিকাংশ
হাদিসবিদের বক্তব্যসমূহের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত; আর তাদের রেওয়ায়েত তথা
বর্ণনার পরিমাণ দুই হাজারের বেশি, যার সবগুলোই কুরআন বিকৃত হওয়ার পক্ষে
বক্তব্য প্রদান করছে। সুতরাং তাদের
নিষ্পাপ(!) ইমামগণ, অধিকাংশ হাদিসবেত্তা এবং শিয়াদের প্রবীণ বিশিষ্ট
ব্যক্তিবর্গের বক্তব্যসমূহের সামনে ঐ চার মিসকীনের বক্তব্যের কোন ভারত্ব
নেই। তাছাড়া ঐ চারজন এমন পরিস্থিতির শিকার হয়ে ‘তাকীয়া’ পদ্ধতির অনুসরণ করে
(আল-কুরআনুল কারীম) অবিকৃত বলে মন্তব্য করেছেন, যে পরিস্থিতিতে তাদের
(আল-কুরআনুল কারীম) বিকৃত বলে মন্তব্য করার কোন সুযোগ ছিল না; বিশেষ করে
যখন সে ‘তাকীয়া’-এর ফযিলত এবং তাদের নিকট তার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব
সম্পর্কে জানতে পারল। অচিরেই আমরা তার কিছু দিক এই গ্রন্থের মধ্যে
যথাস্থানে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। এমনকি শিয়াদের বিদগ্ধ পণ্ডিতগণ ঐ চারজন
আলেমের বক্তব্যসমূহের কড়া সমালোচনা করেছেন। যেমন হোসাইন ইবন মুহাম্মদ তকী
আন-নূরী আত-তাবারসী তার ‘ফাসলুল খিতাব ফি তাহরীফে কিতাবে রাব্বিল আরবাব’ (فصل الخطاب في تحريف كتاب رب الأرباب) নামক কিতাবের ৩৩ পৃষ্ঠায় যা এসেছে তার ভাষ্য হচ্ছে,
(لم يعرف من القدماء موافق لهم)
আর শিয়াদের
অধিকাংশ মুহাদ্দিস আল-কুরআনের মধ্যে পরিবর্তন-পরিবর্ধন বা বিকৃতি হওয়ার কথা
বিশ্বাস করে, যেমন হোসাইন ইবন মুহাম্মদ তকী আন-নূরী আত-তাবারসী তার
‘ফাসলুল খিতাব ফি তাহরীফে কিতাবে রাব্বিল আরবাব’ (فصل الخطاب في تحريف كتاب رب الأرباب) নামক কিতাবের ৩২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করে বলেন,
(وهو مذهب جمهور المحدثين الذين عثرنا على كلماتهم)
(আর এটা অধিকাংশ মুহাদ্দিসের মাযহাব, যাদের বক্তব্যসমূহ আমরা জানতে পেরেছি)।
আমাদের ইচ্ছা যে,
আমরা শিয়াদের নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহ থেকে সামান্য কিছু পরিমাণ বর্ণনা সূত্র
সহ পেশ করব, যাতে প্রমাণ হবে যে, তারা আল-কুরআন বিকৃত হয়েছে বলে বিশ্বাস
করে থাকে।
মুহাম্মদ ইবন ইয়াকুব আল-কুলাইনী তার উসুলুল কাফী (أصول الكافي) নামক গ্রন্থে ( باب أنه لم يجمع القرآن كله إلا الأئمة و أنهم يعلمون علمه كله/ অধ্যায়, ইমামগণই আল-কুরআনকে পরিপূর্ণ সংকলন করেন এবং তারাই তার পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখে) শিরোনামের অধীনে বর্ণনা করেন:
“জাবের থেকে
বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি আবূ জাফর আ.-কে বলতে শুনেছি, মানুষের মধ্যে
মিথ্যাবাদী ছাড়া কেউ দাবি করতে পারে না যে, আল্লাহ যেভাবে কুরআন নাযিল
করেছেন, সে তা পরিপূর্ণভাবে সেভাবে সংকলন করেছে; বরং আলী ইবন আবি তালিব ও
তার পরবর্তী ইমামগণই আল্লাহ যেভাবে তা নাযিল করেছেন, ঠিক সেভাবে সংকলন ও
সংরক্ষণ করেছেন।”
কুলাইনী তার উসুলুল কাফী (أصول الكافي) নামক গ্রন্থের ৬৭ পৃষ্ঠায় (ভারতীয় ছাপা) আরও বর্ণনা করেন:
“সালেম ইবন সালামা
থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: জনৈক ব্যক্তি আবূ আবদিল্লাহ আ.-এর নিকট (কুরআন
থেকে) পাঠ করছিল; আর আমি আল-কুরআনের এমন কতগুলো শব্দ শুনলাম, যা কুরআনের
সর্বজনবিদিত পাঠের মত নয়। অতঃপর আবূ আবদিল্লাহ বললেন: তুমি এই ধরনের পাঠ
থেকে বিরত থাক; পাঠ কর মানুষ যেভাবে পাঠ করে; যতক্ষণ না কায়েম বা মাহদীর
উত্থান ঘটবে, যখন সে কায়েম বা মাহদীর উত্থান হবে, তখন আল্লাহর কিতাবকে তার
সীমারেখায় রেখে পাঠ করা হবে; আর তিনি কুরআনের ঐ কপিটি বের করবেন, যা আলী আ.
লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তিনি আরও বললেন,
আলী আ. যখন তা লিপিবদ্ধ করে অবসর হলেন, তখন তিনি জনগণের নিকট তা বর্ণনা
করলেন এবং তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন: এটা আল্লাহ তা‘আলার কিতাব, যেমনিভাবে
তা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা নাযিল
করেছেন; আমি দু’টি ফলক থেকে তা সংকলন করেছি। তখন লোকেরা বলল: আমাদের নিকটে
তো কুরআন সংকলিত রয়েছে; এর কোন প্রয়োজন আমাদের নেই। অতঃপর আলী বললেন: জেনে
রাখ! আল্লাহর শপথ, আজকের এই দিনের পরে তোমরা তা আর কখনও দেখতে পাবে না;
কারণ, যখন আমি তা সংকলন করি, তখন আমার উপর দায়িত্ব ছিল যে, আমি তা
তোমাদেরকে জানাব, যাতে তা তোমরা পাঠ করতে পার।”[44]
কুলাইনী তার উসুলুল কাফী (أصول الكافي) নামক গ্রন্থের (ভারতীয় ছাপা) ৬৭০ পৃষ্ঠায় আরও বর্ণনা করেন:
“আহমদ ইবন
মুহাম্মদ ইবন আবি নসর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমার নিকট আবুল হাসান আ.
একটি কুরআনের কপি হস্তান্তর করলেন এবং বললেন, তুমি তাতে দৃষ্টি দেবে না;
কিন্তু আমি তা খুলে ফেললাম এবং তাতে পড়লাম "لم يكن الذين كفروا" অতঃপর তাতে পিতার নামসহ কুরাইশ বংশের সত্তর ব্যক্তির নাম পেলাম।”
কুলাইনী তার উসুলুল কাফী (أصول الكافي) নামক গ্রন্থের ২৬৩ পৃষ্ঠায় ( باب فيه نكت و نتف من التنزيل في الولاية) নামক অধ্যায়ে বর্ণনা করেন:
“আবূ আবদিল্লাহ আ. থেকে বর্ণিত: " و لقد عهدنا إلي آدم من قبل كلمات في محمد و علي و فاطمة و الحسن و الحسين و الأئمة من ذريتهم فنسي " (আর
আমি ইতঃপূর্বে আদমের প্রতি তার বংশধরের মধ্য থেকে মুহাম্মদ, আলী, ফাতেমা,
হাসান, হোসাইন এবং ইমামদের ব্যাপারে কতগুলো নির্দেশ দান করেছিলাম; কিন্তু
সে ভুলে গিয়েছিল।) আল্লাহর কসম, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
প্রতি অনুরূপই অবতীর্ণ হয়েছিল।”
কুলাইনী তার উসুলুল কাফী (أصول الكافي) নামক গ্রন্থের ২৬৩ পৃষ্ঠায় আরও বর্ণনা করেন:
“আবূ আবদিল্লাহ আ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: জিবরাইল আ. মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর এই আয়াত নাযিল করেন:
" يا أيها الذين أوتوا الكتاب آمنوا بما نزلنا في علي نورا مبينا "
“হে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে! আমরা আলী’র ব্যাপারে যে সুস্পষ্ট নুর বা আলো অবতীর্ণ করেছি, তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর।”
আর তাদের কেউ কেউ
বলে: ওসমান কুরআনের কপিগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে এবং আলী আ. ও তার পরিবার-পরিজনের
মর্যাদা বর্ণনায় যেসব সূরা ছিল, সে তা ধ্বংস কর দিয়েছে; তন্মধ্যে এই
সূরাটিও ছিল:
" بسم
الله الرحمن الرحيم يا أيها الذين آمنوا آمنوا بالنورين أنزلناهما يتلوان
عليكم آياتي و يحذرانكم عذاب يوم عظيم نوران بعضهما من بعض و أنا السميع
العليم ".
(আল্লাহর নামে
শুরু করছি; হে ঈমানদারগণ! তোমরা দুই নুরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, যা
আমরা নাযিল করেছি; তারা তোমাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে এবং মহান
দিবসের শাস্তির ভয় প্রদর্শন করবে; উভয় নুর পরস্পর পরস্পরের অংশ; আর আমি
শ্রবণকারী, জ্ঞানী।)[45]
আর মোল্লা হাসান উল্লেখ করেন:
“আবূ জাফর আ. থেকে
বর্ণিত, তিনি বলেন: যদি আল্লাহর কিতাবের মধ্যে কম-বেশি করা না হত, তবে
কোন বিবেকবানের কাছেই আমাদের হক (অধিকার) গোপন থাকত না।”[46]
আহমদ ইবন আবি তালিব আত-তাবারসী ‘আল-ইহতিজাজ’ (الاحتجاج) নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন:
“আবূ যর গিফারী
থেকে বর্ণিত, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকাল
করেন, তখন আলী কুরআন সংকলন করেন এবং তা মুহাজির ও আনসারদের নিকট নিয়ে আসেন;
অতঃপর তিনি তা তাদের নিকট পেশ করেন; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই জন্য তাকে অসিয়ত করেছিলেন। অতঃপর যখন আবূ বকর তা
খুললেন, তখন প্রথম পৃষ্ঠার শুরুতেই বের হয়ে আসল সম্প্রদায়ের লোকদের
দোষ-ত্রুটি ও অসম্মানের কথা; অতঃপর ওমর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল এবং বলল: হে আলী!
তুমি তা ফেরত নিয়ে যাও; কারণ, এতে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। অতঃপর আলী আ. তা
ফেরত নিয়ে নিলেন এবং সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। অতঃপর যায়েদ ইবন সাবিতকে
হাযির করা হল, আর সে ছিল কুরআনের কারী (পাঠক); অতঃপর তাকে ওমর বলল: আলী
আমাদের নিকট এমন এক কুরআন নিয়ে এসেছে, যার মধ্যে মুহাজির ও আনসারদের
অসম্মান ও অপমান করা হয়েছে। সুতরাং আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি যে, আমরা
কুরআন সংকলন করব এবং তার থেকে ঐ অংশ বাদ দেব, যাতে মুহাজির ও আনসারদের
অসম্মান ও অপমান করা হয়েছে। অতঃপর যায়েদ তার আহ্বানে সাড়া দিল এবং বলল, যদি
আমি তোমাদের দাবি মোতাবেক কুরআন সংকলনের কাজ সমাপ্ত করি; আর আলীও তার
সংকলন করা কুরআন প্রকাশ করে, তবে কি তোমরা যে কাজ করেছ, তা বাতিল করে দেবে
না? তখন ওমর বলল: তাহলে উপায় কী? যায়েদ বলল: উপায় সম্পর্কে তোমরাই ভাল
জান। তখন ওমর বলল: তাকে হত্যা করা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই এবং আমাদের
স্বস্তিও নেই। অতঃপর সে খালিদ ইবন ওয়ালিদের হাতে তাকে হত্যার পরিকল্পনা
করল, কিন্তু এই কাজে সে সক্ষম হয়নি। সুতরাং যখন ওমর খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ
করে, তখন তারা আলী আ.-এর নিকট আবেদন করে যে, তিনি যেন তাদের নিকট কুরআন
হস্তান্তর করেন; যাতে তারা তাতে পরিবর্তন করতে পারে। অতঃপর ওমর বলল: হে
হাসানের পিতা! যদি আপনি ঐ কুরআনটা নিয়ে আসতেন, যা আপনি আবূ বকরের নিকট নিয়ে
এসেছিলেন; কেননা শেষ পর্যন্ত আমরা তার ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছেছি; তখন তিনি
বললেন: অসম্ভব! এটা পুনরায় নিয়ে আসার আর কোন সুযোগ নেই; আমি তো আবূ বকরের
নিকট তা শুধু এই জন্য নিয়ে এসেছিলাম, যাতে তোমাদের উপর দলিল-প্রমাণ
প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তোমরা কিয়ামতের দিন এই কথা বলতে না পার: ﴿ إِنَّا كُنَّا عَنۡ هَٰذَا غَٰفِلِينَ ﴾ (আমরা তো এই বিষয়ে গাফিল ছিলাম); অথবা তোমরা বলতে না পার: ﴿ مَا جِئۡتَنَا بِبَيِّنَةٖ ﴾ (তুমি তো আমাদের নিকট প্রমাণ নিয়ে আস নি)। আমার নিকট যে কুরআন রয়েছে, তা পবিত্র ব্যক্তিগণ ও আমার বংশের অসীগণ ছাড়া অন্য কেউ স্পর্শ করতে পারবে না; অতঃপর ওমর বলল: তা প্রকাশ করার কোন নির্দিষ্ট সময় আছে কি? তখন আলী আ. বলল: হ্যাঁ, যখন আমার বংশধর থেকে কায়েম (অর্থাৎ মাহদী) শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে, তখন সে তা প্রকাশ করবে এবং জনগণ তা গ্রহণ করবে।”[47]
আর নুরী আত-তাবারসী ‘ফসলুল খিতাব’ (فصل الخطاب)-এর মধ্যে বলেন:
“আমীরুল মুমিনীনের
একটি বিশেষ কুরআন ছিল, যা তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম ইন্তিকালের পর নিজেই সংকলন করেন এবং তা জনসমক্ষে পেশ করেন;
কিন্তু তারা তা উপেক্ষা করে। অতঃপর তিনি তা তাদের দৃষ্টি থেকে গোপন করে
রাখেন; আর তা ছিল তার সন্তান তথা বংশধরের নিকট সংরক্ষিত, ইমামত তথা
নেতৃত্বের সকল বৈশিষ্ট্য ও নবুয়তের ভাণ্ডারের মত যার উত্তরাধিকারী হয় এক
ইমাম থেকে অপর ইমাম। আর তা প্রমাণ (মাহদী) এর নিকট সংরক্ষিত রয়েছে। -আল্লাহ
আল্লাহ দ্রুত তাকে মুক্ত করে দিন- ; তিনি তখন তা জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন
এবং তাদেরকে তা পাঠ করার নির্দেশ দিবেন; আর তা সংকলন, সূরা ও আয়াতসমূহের
ধারাবাহিকতার দিক থেকে বিদ্যমান এই কুরআনের বিপরীত; এমনকি শব্দসমূহও
কম-বেশি করার দৃষ্টিকোণ থেকে তার বিপরীত। আর যেখানে সত্য আলী’র সাথে; আর
আলী সত্যের সাথে, সেখানে বিদ্যমান কুরআনের মধ্যে উভয়দিক থেকেই পরিবর্তন
রয়েছে; আর এটাই উদ্দেশ্য।”[48] হ্যাঁ, সে (নূরী তাবরসী এর) এ রকম ভাষ্য ও শব্দে এ জঘন্য কথাটি বলেছে, আল্লাহ তার উপর অভিশাপ করুন।
আর আহমাদ ইবন আবী
তালিব আত তাবারসী তার আল-ইহতিজাজ গ্রন্থে বলেন, তারপর তাদের কাছে যে সমস্ত
মাসআলা আপতিত হলো নিজেদের পক্ষ থেকে তাদের কুফরীকে সাব্যস্ত করার জন্য তারা
সেগুলোকে একত্রিত করতে ও সংকলন করতে বাধ্য হলো... তাছাড়া তারা আরও এমন
কিছু তাতে বর্ধিত করলো যার অগ্রহণযোগ্যতা ও অস্বীকৃতির ব্যাপারটি ছিল
প্রকাশিত .. এভাবে মুলহিদ শ্রেণীর লোকদের পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী এর উপর মিথ্যাচার করে কুরআন শুরু করল। আর
এজন্যই মিথ্যা ও অসার কথা তারা বলেছে এবং বলে থাকে[49]। [50]
হোসাইন আন-নুরী আত-তাবারসী ‘ফসলুল খিতাব’ (فصل الخطاب) নামক গ্রন্থের মধ্যে আরো বলেন:
“অনেক প্রবীণ
রাফেযীর নিকট থেকে বর্ণিত আছে যে, আমাদের নিকট যে কুরআন বিদ্যমান আছে, তা ঐ
কুরআন নয়, যা আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
উপর নাযিল করেছেন; বরং তা রদবদল করা হয়েছে এবং করা হয়েছে তাতে কম-বেশি।”[51]
মোল্লা হাসান বর্ণনা করেন:
“আবূ জাফর থেকে বর্ণিত, আল-কুরআন থেকে অনেক আয়াত বাদ দেয়া হয়েছে; আর কতগুলো শব্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে।”[52]
মোল্লা হাসান আরও বলেন:
“আহলে বাইত তথা নবী পরিবারের সুত্রে বর্ণিত এসব কাহিনী ও অন্যান্য বর্ণনাসমূহ থেকে বুঝা যায় যে, আমাদের মধ্যে প্রচলিত কুরআন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অবতীর্ণ কুরআনের মত পরিপূর্ণ নয়; বরং তার মাঝে
আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার পরিপন্থী আয়াত যেমন রয়েছে; আবার তেমনি
পরিবর্তিত ও বিকৃত আয়াতও রয়েছে। আর তার থেকে অনেক কিছু বিলুপ্ত করা হয়েছে;
তন্মধ্যে অনেক জায়গায় আলী’র নাম বিলুপ্ত করা হয়েছে; আবার একাধিক বার "آل محمد" (মুহাম্মদের বংশধর) শব্দটি বিলুপ্ত
করা হয়েছে; আরও বিলুপ্ত করা হয়েছে মুনাফিকদের নামসমূহ এবং ইত্যাদি
ইত্যাদি। আর এটা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পছন্দসই ক্রমধারা অনুযায়ী সাজানোও
নয়।”[53]
আর কুলাইনী বর্ণনা করেন:
“আবূ আবদিল্লাহ আ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নিশ্চয় জিবরাঈল আ. যে কুরআন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট নিয়ে এসেছে, তাতে আয়াত সংখ্যা সতের হাজার।”[54]
অথচ আমাদের সামনে বিদ্যমান কুরআনে আছে ছয় হাজার ছয়শত ছেষট্টি আয়াত[55]। সুতরাং মনে হচ্ছে যেন তার থেকে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ আয়াত বিলুপ্ত করা হয়েছে এবং শুধু এক তৃতীয়াংশ আয়াত বাকি আছে। ‘মিরআতুল ‘ওকুল’ (مرآة العقول) নামক
গ্রন্থের লেখক কুলাইনী কর্তৃক আবূ আবদিল্লাহ আ. থেকে বর্ণিত উক্ত হাদীসের
টীকায় বলেন: সুতরাং হাদিসটি বিশুদ্ধ; আর এই কথা অস্পষ্ট নয় যে, আল-কুরআনের
ত্রুটি-বিচ্যুতি ও রদবদলের ব্যাপারে এই হাদিসটি ও আরও বহু বিশুদ্ধ হাদিসের
বক্তব্য সুস্পষ্ট। আর আমার মতে, এই অধ্যায়ের হাদিসগুলো অর্থের দিক থেকে
মুতাওয়াতির পর্যায়ের এবং সামগ্রিকভাবে এগুলোকে উপেক্ষা করার মানে মূলত
হাদিসের উপর নির্ভরশীলতাকে বাধ্যতামূলকভাবে উপেক্ষা করা; বরং আমার ধারণা,
এই অধ্যায়ের হাদিসগুলো ইমামতের হাদিসের চেয়ে কম নয়। সুতরাং তারা কিভাবে
হাদিস দ্বারা তা সাব্যস্ত করবে।[56]
‘আল-কাফী’
গ্রন্থের ব্যাখ্যাকার মোল্লা খলিল আল-কাযবীনী উপরে উল্লেখিত হাদিসের সত্যতা
প্রসঙ্গে ফারসি ভাষায় বলেন, যার আরবি অনুবাদের (বাংলা) হল:
“তার (হাদিস)
দ্বারা উদ্দেশ্য হল, বহু আয়াত আল-কুরআন থেকে বিলুপ্ত করা হয়েছে; আর তা
প্রসিদ্ধ কপিসমূহের মধ্যে নেই। আর বিশেষ ও সাধারণ পদ্ধতিতে বর্ণিত বিশুদ্ধ
হাদিসসমূহ আল-কুরআনের একটা বিরাট অংশ বিলুপ্তির প্রমাণ করে। আর এই
হাদিসগুলো একটা বিরাট সংখ্যায় পৌঁছেছে, যার সবগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা
রীতিমত দুঃসাহস বলে বিবেচনা করা হয়। আর দাবি করা হয় যে, গ্রন্থসমূহে
বিদ্যমান এই কুরআন জটিলতা মুক্ত নয়। আর আবূ বকর, ওমর ও ওসমানের কর্মকাণ্ড
উপলব্ধি করার পর আল-কুরআন সংকলনের ব্যাপারে সাহাবী ও ইসলামের অনুসারীগণ
কর্তৃক গুরুত্বারোপের দলিলগুলো দুর্বল দলিল বলে প্রমাণিত। আর অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলার বাণী:[57]﴿ إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩ ﴾ আয়াত দ্বারা দলিল পেশ করাটা দলিলের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। কারণ, এখানে আয়াতটি অতীতকালীন শব্দ দ্বারা পেশ করা হয়েছে এবং তা মাক্কী সূরার অন্তর্ভুক্ত। আর
এই সূরা নাযিল হওয়ার পর মক্কাতে আরও অনেক সূরা অবতীর্ণ হয়েছে এবং এই
সূরাগুলো ছাড়া মদিনাতেও আরও বহু সূরা অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তাতে এই কথা
বুঝায় না যে, গোটা কুরআন সংরক্ষিত ...। আর কুরআন সংরক্ষণের দ্বারা এই কথাও বুঝায় না যে, তা সকল মানুষের নিকট সংরক্ষিত থাকবে। কারণ, হতে পারে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, তা সংরক্ষিত থাকবে যুগের ইমাম ও তার অনুসারীদের নিকট, যারা তার গোপন রহস্যের অধিকারী।”[58]
হোসাইন আন-নুরী আত-তাবারসী ‘ফসলুল খিতাব’ (فصل الخطاب) নামক গ্রন্থের মধ্যে আরও বলেন:
“কুরআনের বিশেষ
বিশেষ স্থানের ব্যাপারে বর্ণিত হাদিসসমূহ পূর্বে আলোচিত পদ্ধতিসমূহের কোন
এক পদ্ধতিতে কুরআনের কোন কোন শব্দ, আয়াত ও সূরার পরিবর্তন ও রদবদল প্রমাণ
করে। আর এর পরিমাণ অনেক বেশি; এমনকি সাইয়্যেদ নিয়ামত উল্লাহ আল-জাযায়েরী
তার কোন কোন গ্রন্থে বলেন: এই বিষয়টি প্রমাণ করার মত হাদিসের সংখ্যা দুই
হাজারেরও অধিক এবং এই হাদিসগুলো প্রসিদ্ধ হাদিস বলে দাবি করেছেন মুফিদ,
পণ্ডিত দামাদ, আল্লামা আল-মুজাল্লেলী প্রমুখের মত একদল; তাছাড়া শাইখও তার
‘তিবয়ান’ গ্রন্থে তার সংখ্যাধিক্যতার কথা স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন। এমনকি আরও
একদল হাদিসগুলোকে ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের বলে দাবি করেছে, যাদের আলোচনা আসছে
এই অধ্যায়ের শেষে।”[59]
হোসাইন আন-নুরী আত-তাবারসী আরও বলেন:
মুহাদ্দিস সাইয়্যেদ আল-জাযায়েরী ‘আনওয়ার’ গ্রন্থে বলেন, যার অর্থ হল:
বিশেষ ব্যক্তিবর্গ প্রসিদ্ধ তথা মুতাওয়াতির হাদিসসমূহের বিশুদ্ধতার
ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন, যা আল-কুরআনের মধ্যে বাক্যগত, শব্দগত ও ই‘রাবগত
রদবদল ও বিকৃতি সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ বহন
করে।[60]
আন-নুরী আত-তাবারসী আরও বলেন:
অনেক নির্ভরযোগ্য হাদিস সুস্পষ্ট করে দিয়েছে বিদ্যমান কুরআনের মধ্যে
বিকৃতি, ত্রুটি-বিচ্যুতি ও কম-বেশি সংঘটিত হওয়ার বিষয়টিকে, যা
বিচ্ছিন্নভাবে পূর্ববর্তী দলিলসমূহের মধ্যে আলোচিত হয়েছে। আর মানুষ ও জিন
জাতির নেতার হৃদয়ে মু‘জিযা স্বরূপ আয়াত অথবা সূরার সাথে নির্দিষ্ট না করে
যা নাযিল করা হয়েছে, এই কুরআন তার থেকে অনকে কম ও অপূর্ণাঙ্গ। আর তা
বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক স্বীকৃত ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহে
বিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যমান আছে।[61]
আন-নুরী আত-তাবারসী আরও বলেন:
জেনে রাখবেন, এই হাদিসগুলো নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহ থেকে উদ্ধৃত; শরীয়তের
বিধি-বিধান ও সুন্নাতে নববী সাব্যস্তকরণের ক্ষেত্রে আমাদের সহকারীবৃন্দ যার
মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে।[62]
শিয়া আলেমগণ
অনেকগুলো বর্ণনার উল্লেখ করেছেন, যেগুলো আল-কুরআনের মধ্যে ব্যাপক আকারে
বিকৃতির প্রমাণ করে এবং আল্লামা মুহাম্মদ বাকের আল-মজলিসী আল-কুরআনের মধ্যে
বিকৃতির ব্যাপারে যুক্তিভিত্তিক প্রমাণও পেশ করেছেন; যেমন তিনি বলেন: আকল
তথা বিবেকের ফয়সালা হল, যখন আল-কুরআন জনগণের নিকট বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত
আকারে ছিল এবং তা সংকলনের জন্য যারা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তারা নিষ্পাপ ছিল
না; তখন স্বাভাবিকভাবেই তার পরিপূর্ণ ও যথাযথ সংকলন বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।
কিন্তু এতে সন্দেহ নেই যে, স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যক্তি তথা ইমামের আবির্ভাব
হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মানুষ গ্রন্থসমূহ (মাসহাফ) ও তিলাওয়াতের মধ্যে যা আছে,
সে অনুযায়ী আমল করতে বাধ্য। এটাও
আহলে বাইত আ. সুত্রে জানা ও মুতাওয়াতির বিষয়। আর এই অধ্যায়ের অধিকাংশ
হাদিস আল-কুরআনের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও রদবদলের উপর দলিল; অচিরেই তার অনেকগুলো
দলিল সামনের অধ্যায়সমূহে আসবে; বিশেষ করে আল-কুরআনের ফযিলতের অধ্যায়ে।
আল্লাহ তা‘আলা চাহে তো এই প্রসঙ্গে প্রাণভরে অনেকগুলো বক্তব্য পেশ করব।[63]
আর ঐসব বর্ণনার
(রেওয়ায়েতের) অংশ বিশেষ বিস্তারিত আলোচনা করার পর, যা শিয়াগণ তাদের
গ্রন্থসমূহে বর্ণনা করেছে এবং তাদের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের পক্ষ থেকে
সত্যায়ণ করেছে যে, নিশ্চয় তা (এসব বর্ণনা) কুরআনের মধ্যে বিকৃতি হওয়ার
ব্যাপারে বিশুদ্ধ, সুস্পষ্ট ও মুতাওয়াতির পর্যায়ের; আমরা এই বর্ণনা অনুযায়ী
তাদের আকিদার উল্লেখ করব এইভাবে যে, নিশ্চয় বিদ্যমান কুরআন বিকৃত ও
পরিবর্তিত; সুতরাং ‘আত-তাফসীরুস সাফী’ (التفسير الصافي)-এর গ্রন্থকার বলেন:
“এই ব্যাপারে
আমাদের শাইখবৃন্দের আকিদা-বিশ্বাস ইসলামের বিশ্বস্ত ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ
ইবন ইয়াকুব আল-কুলাইনী’র বক্তব্য ও বিশ্বাস থেকে পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট; তিনি
কুরআনের মধ্যে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও বিকৃতির আকিদায় বিশ্বাসী। কারণ, তিনি এই
অর্থে তার ‘কাফী’ নামক গ্রন্থে বহু বর্ণনার (রেওয়ায়েতের) অবতারণা করেছেন;
কিন্তু তাতে দোষ-ত্রুটি প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন নি; এমনকি গ্রন্থের
শুরুতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তিনি তাতে যা বর্ণনা করেছেন, তা তিনি সত্য
বলে বিশ্বাস করেন। অনুরূপ হলেন তার শিক্ষক আলী ইবন ইবরাহীম আল-কুমী; কারণ,
তার তাফসীরখানা এ ধরণের বর্ণনা দ্বারা ভরপুর এবং তাতে তার বাড়াবাড়িও আছে।
আর অনুরূপ হলেন শাইখ আহমদ ইবন আবি তালিব আত-তাবারসী; কেননা তিনিও তার
‘ইহতিজাজ’ নামক গ্রন্থে তাদের পথ ও পন্থে চলেছেন।”[64] অর্থাৎ তাদের মত করে তিনি তার গ্রন্থে এ সব বর্ণনা উল্লেখ বর্ণনা করেছেন।
আর শিয়া
মুহাদ্দিসদের অনেকে এই বিষয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন; তাতে তারা
প্রমাণ করেছেন যে, আল-কুরআন বিকৃত এবং তাতে রদবদল করা হয়েছে। যেমন হোসাইন
ইবন মুহাম্মদ তকী আন-নূরী আত-তাবারসী তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘ফাসলুল খিতাব ফি
তাহরীফে কিতাবে রাব্বিল আরবাব’ (فصل الخطاب في تحريف كتاب رب الأرباب ) -এর মধ্যে ঐসব গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন।
আর তিনি তার
কিতাবের ভূমিকায় বলেন: এটা একটি চমৎকার গ্রন্থ ও পবিত্র কিতাব, যা আমি
সম্পাদন করেছি আল-কুরআনের বিকৃতি এবং অত্যাচারীদের লজ্জাজনক কাজের প্রমাণ
স্বরূপ; আর তার নামকরণ করেছি ‘ফাসলুল খিতাব ফি তাহরীফে কিতাবে রাব্বিল
আরবাব’ (فصل الخطاب في تحريف كتاب رب الأرباب )।
অতঃপর তিনি এই বিষয়ের উপর যেসব গ্রন্থ রচনা করেছেন, এই কিতাবের ২৯ পৃষ্ঠায় তার একটি তালিকা পেশ করেছেন; তিনি উল্লেখ করেছেন:
১. কিতাবুত তাহরীফ (كتاب التحريف)
২. কিতাবুত তানযীল ওয়াত তাগয়ীর (كتاب التنزيل و التغيير)
৩. কিতাবুত তানযীল মিনাল কুরআন ওয়াত তাহরীফ (كتاب التنزيل من القرآن و التحريف)
৪. কিতাবুত তাহরীফ ওয়াত তাবদীল (كتاب التحريف و التبديل)
৫. আত-তানযীল ওয়াত তাহরীফ (التنزيل و التحريف)
সুতরাং এই
গ্রন্থসমূহ আমাদেরকে জানাচ্ছে যে, তাদের নিকট এই আকিদাটি (বিশ্বাসটি) দীনের
জরুরী বিষয়সমূহের অন্যতম একটি; যার কারণে তারা এই বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা
করেছেন।
আর এই বর্ণনাগুলো
দুর্বল বলে শিয়াদের কেউ কেউ যে আপত্তি উত্থাপন করে, তা এক ধরনের দুর্বল
আপত্তি; কারণ, অধিকাংশ শিয়া মুহাদ্দিস ও তাদের বিশেষ ব্যক্তিবর্গ এই
বর্ণনাসমূহ পেশ করেছে এবং সত্যায়ণ করেছেন। আর তাদের মধ্য থেকে কেউ এই
বর্ণনাসমূহের বিপরীত কোন বর্ণনা পেশ করে নি এবং বর্ণনা করে নি এই আকিদার
বিপরীত ভিন্ন কোন আকিদা; বরং তারা নিশ্চিন্তমনে কুরআন বিকৃত হওয়ার আকিদায়
বিশ্বাসী। আর আমরা শিয়া আলেমদের নিকট আবেদন করি, তারা যখন স্বীকৃতি প্রদান
করে যে, আল-কুরআন অবিকৃত ও অপরিবর্তিত অবস্থায় সংরক্ষিত আছে, তখন তাদের উপর
বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে:
প্রথমত: তারা
তাদের নিষ্পাপ ইমামদের নিকট থেকে একটি বর্ণনা (রেওয়ায়েত) নিয়ে আসবে, যা
তাদের নিকট নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহের মধ্য থেকে যে কোন একটি কিতাবে উল্লেখ
আছে এবং তা প্রমাণ করবে যে, আল-কুরআন পরিপূর্ণভাবে অবিকৃত অবস্থায় সংরক্ষিত
আছে; কিন্তু তারা এই ধরনের বর্ণনা কিয়ামত পর্যন্ত কখনও নিয়ে আসবে না।
দ্বিতীয়ত: তাদের
উপর আবশ্যক হয়ে পড়বে ঐ ব্যক্তিকে কাফির বলা, যে ব্যক্তি আল-কুরআনকে বিকৃত
বলে এবং তাদের এই আকিদাকে পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ
করা।
আর তাদের উপর আরও
আবশ্যক হয়ে পড়বে আল-কুরআন বিকৃত হওয়ার প্রমাণ স্বরূপ বর্ণিত এই বর্ণনাসমূহ
তাদের সভা ও সমাবেশে প্রচার ও প্রচলন না করা; বরং এসব বর্ণনার ধারক ও
বাহকগণের উপর আবশ্যক হয়ে পড়বে তাদের সভা ও সমাবেশে এগুলো প্রচার করা থেকে
বিরত থাকা এবং ঐসব কিতাবসমূহকে ভুল বলে আখ্যায়িত করা, যেগুলোতে এই ধরনের
মিথ্যা, বানোয়াট ও ভ্রান্ত বর্ণনাসমূহ বর্ণিত হয়েছে। যেমন উসূলুল কাফী (أصول الكافي), আল-ইহতিজাজ (الاحتجاج) ইত্যাদি।
আমরা এই
পৃষ্ঠাগুলোতে আল-কুরআনের মধ্যে বিকৃতি হওয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট শিয়াদের
আকিদা উপস্থাপন করেছি, যেই আকিদাকে সমর্থন যুগিয়েছে তাদের মতানুসারে
মুতাওয়াতির পর্যায়ের বর্ণনা (রেওয়ায়েত) এবং তাদের মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও
বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বক্তব্যসমূহ। সুতরাং তাদের মধ্য থেকে কেউ তা
অস্বীকার করতে পারবে না; আর তাদের এই বক্তব্যগুলো তাদের কুৎসিত চেহারা থেকে
মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে এবং আমাদের সামনে পবিত্র কিতাবকে কেন্দ্র করে
তাদের আকিদাসমূহ স্পষ্ট করে দিয়েছে, অথচ এ কিতাব এমন যে, বাতিল তার সামনে ও
পেছনে কোনভাবেই আগমন করতে পারে না। কারণ এটি প্রজ্ঞাময় প্রশংসিত আল্লাহর
নাযিলকৃত কিতাব। এই সম্মানিত কিতাবের ব্যাপারে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা বলেন:
﴿ الٓمٓ ١ ذَٰلِكَ ٱلۡكِتَٰبُ لَا رَيۡبَۛ فِيهِۛ هُدٗى لِّلۡمُتَّقِينَ ٢ ﴾ [سورة البقرة: 1-2[
“আলিফ-লাম-মীম, এটা সেই কিতাব; এতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তকীদের জন্য তা পথ প্রদর্শক” —(সূরা আল-বাকারা: ১-২)
তিনি আরও বলেন:
﴿ إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩ ﴾ [سورة الحجر: 9]
“আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং অবশ্যই আমি তার সংরক্ষক”। — (সূরা আল-হিজর: ৯)
তিনি আরও বলেন:
﴿ لَا
تُحَرِّكۡ بِهِۦ لِسَانَكَ لِتَعۡجَلَ بِهِۦٓ ١٦ إِنَّ عَلَيۡنَا
جَمۡعَهُۥ وَقُرۡءَانَهُۥ ١٧ فَإِذَا قَرَأۡنَٰهُ فَٱتَّبِعۡ قُرۡءَانَهُۥ
١٨ ثُمَّ إِنَّ عَلَيۡنَا بَيَانَهُۥ ١٩ ﴾ [سورة القيامة: 16-19]
“তাড়াতাড়ি ওহী
আয়ত্ব করার জন্য তুমি তোমার জিহ্বা তার সাথে সঞ্চালন করো না। এটা সংরক্ষণ ও
পাঠ করাবার দায়িত্ব আমারই। সুতরাং যখন আমি তা পাঠ করি, তখন তুমি সেই পাঠের
অনুসরণ কর; অতঃপর এর বিশদ ব্যাখ্যার দায়িত্ব আমারই।” — (সূরা আল-কিয়ামা:
১৬-১৯)
তিনি আরও বলেন:
﴿ وَإِن كُنتُمۡ فِي رَيۡبٖ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلَىٰ عَبۡدِنَا فَأۡتُواْ بِسُورَةٖ مِّن مِّثۡلِهِۦ ﴾ [سورة البقرة: 23]
“আমি আমার বান্দার
প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি, তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা তার অনুরূপ
কোন সূরা নিয়ে আস।” — (সূরা আল-বাকারা: ২৩)
তিনি আরও বলেন:
﴿ قُل
لَّئِنِ ٱجۡتَمَعَتِ ٱلۡإِنسُ وَٱلۡجِنُّ عَلَىٰٓ أَن يَأۡتُواْ بِمِثۡلِ
هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانِ لَا يَأۡتُونَ بِمِثۡلِهِۦ وَلَوۡ كَانَ بَعۡضُهُمۡ
لِبَعۡضٖ ظَهِيرٗا ٨٨ ﴾ [سورة الإسراء: 88]
“বল, যদি এই
কুরআনের অনুরূপ কুরআন নিয়ে আসার জন্য মানুষ ও জিন সমবেত হয় এবং যদিও তারা
পরস্পরকে সাহায্য করে, তবুও তারা এর অনুরূপ আনয়ন করতে পারবে না।” — (সূরা
আল-ইসরা: ৮৮)
আর মুসলিমগণ
সামগ্রিকভাবে ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, নিশ্চয় পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত এবং
তন্মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থানরত মুসলিমদের সামনে বিদ্যমান আল-কুরআনের
কপিগুলোর প্রথম থেকে শুরু করে সূরা ফালাক ও নাসের শেষ পর্যন্ত আল্লাহ
তা‘আলার বাণী এবং তার ওহী, যা তিনি তাঁর নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামের উপর নাযিল করেছেন। সুতরাং তার একটি হরফ (অক্ষর) যে অস্বীকার
করবে, সে কাফির।
তবে শিয়াদের কোন
কোন অসতর্ক ব্যক্তি যখনই পরিপূর্ণ সংরক্ষিত বিদ্যমান কুরআনের প্রতি তার
বিশ্বাস প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয় তখনই বলতে থাকে যে যদিও আমাদের কিতাবসমূহে
কুরআন বিকৃত হওয়া সম্পর্কিত বর্ণনাসমূহ মওজুদ রয়েছে, তাতে কোন সমস্যা নেই।
কারণ, তোমাদের কিতাবগুলোতেও তিলাওয়াত রহিত হওয়া ও কিরাতের বিভিন্নতার কথা
উল্লেখ আছে। বস্তুত: তাদের এই ধরণের প্রমাণ গ্রহণ করা ডুবন্ত ব্যক্তির
খড়কুটো আঁকড়ে ধরার ন্যায়। কারণ, তিলাওয়াত রহিত হওয়ার বিষয়টি আল-কুরআনের
ভাষ্য দ্বারা প্রমাণিত; অনুরূপভাবে কিরাতের বিভিন্নতার বিষয়টিও। সুতরাং
কোথায় ভিজা মাটি, আর কোথায় আকাশের তারকারাজি। নির্বোধ
গোঁড়ামীকারীদের থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। বরং সেই অসতর্ক ব্যক্তির
উচিত আমাদের সামনে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমদের পক্ষ থেকে একটা
বক্তব্য বা উদ্ধৃতি উপস্থাপন করা, যা সুস্পষ্ট করে বলবে যে, আল-কুরআন বিকৃত
অথবা তাতে রদবদল করা হয়েছে; বরং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সকলেই
বিশ্বাস করেন যে, ‘আল-কুরআন বিকৃত’-এই কথার প্রবক্তা কাফির, মুসলিম মিল্লাত
(জাতি) থেকে বহিষ্কৃত।
0 Comments