শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু
প্রেম-ভালোবাসা
প্রশ্ন - আমি যদি দূর থেকে কোনো নারীকে ভালোবাসি তাহলে কি গুনাহ হবে?
উত্তর-
আলহামদুলিল্লাহ
গুনাহ
ও দুষ্কর্মের দরজাগুলো বন্ধ করার জন্য শরিয়ত এসেছে। যা কিছু মানুষের
মনোজগৎ ও বিচার-বিবেচনা শক্তিকে নষ্ট করে দেয়ার মাধ্যম তা বন্ধ করার জন্য
শরিয়ত সকল ব্যবস্থাই গ্রহণ করেছে। আর প্রেম-ভালোবাসা, নরনারীর সম্পর্ক, সব
থেকে বড় ব্যাধি ও মারাত্মক আপদ।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রা. বলেন [ দ্র: মাজমুউল ফাতওয়া: ১০/১২৯]
’
ইশক বা প্রেম একটি মানসিক ব্যাধি। আর যখন তা প্রকট আকার ধারণ করে শরীরকেও
তা প্রভাবিত করে। সে হিসেবে তা শরীরের পক্ষেও ব্যাধি। মস্তিষ্কের জন্যও তা
ব্যাধি। এ-জন্যই বলা হয়েছে, এটা একটা হৃদয়জাত ব্যাধি। শরীরের ক্ষেত্রে এ
ব্যাধির প্রকাশ ঘটে দুর্বলতা ও শরীর শুকিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে।‘
তিনি
আরও বলেন, [দ্র: মাজমুউল ফাতওয়া: ১০/১৩২] ’ পরনারীর প্রেমে এমন সব ফাসাদ
রয়েছে যা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেও গুনে শেষ করতে পারবে না। এটা এমন ব্যাধির
একটি যা মানুষের দীনকে নষ্ট করে দেয়। মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনাকে নষ্ট করে
দেয়, অতঃপর শরীরকেও নষ্ট করে।‘
বিপরীত
লিঙ্গের প্রতি প্রেম-ভালোবাসার ক্ষতি জানার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, এটা
হলো হৃদয়ের বন্দিদশা, আর প্রীতিভাজনের জন্য দাসত্ব, প্রেম-ভালোবাসা
অসম্মান, অপদস্থতা ও কষ্টের দরজা। এগুলো একজন সচেতন মানুষকে এই ব্যাধি থেকে
দূরে সরাতে যথেষ্ট।
ইবনে তাইমিয়াহ রা. বলেন:
[ দ্র: মাজমুউল ফাতওয়া: ১০/১৮৫] পুরুষের হৃদয় যদি কোনো নারীর সাথে এঁটে
যায়, যদিও সে নারী তার জন্য বৈধ হয়, তাহলেও তার হৃদয় থাকে ওই নারীর কাছে
বন্দি। নারী তার অধিপতি হয়ে বসে, পুরুষ তার ক্রীড়নকে পরিণত হয়, যদিও সে
প্রকাশ্যে তার অভিভাবক; কেননা সে তার স্বামী। তবে বাস্তবে সে নারীর কাছে
বন্দি, তার দাস। বিশেষত নারী যদি জানতে পারে যে পুরুষ তার প্রেমে মুগ্ধ।
এমতাবস্থায় নারী তার উপর আধিপত্য চালায়, জালেম ও স্বৈরাচারী শাসক যেমন
তার মাজলুম, নিষ্কৃতি পেতে অপারগ দাসের উপর শাসন চালায়, ঠিক সেভাবেই নারী
তার প্রেমে হাবুডুবু-খাওয়া পুরুষের উপর শাসন চালায়। বরং এর থেকেও বেশি
চালায়। আর হৃদয়ের বন্দিদশা শরীরের বন্দিদশা থেকে মারাত্মক। হৃদয়ের
দাসত্ব শরীরে দাসত্বের চেয়েও কঠিনতর।‘
আর
বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ভালোবাসা ওই হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে না যে হৃদয়ে
আল্লাহর ভালোবাসা ভর্তি রয়েছে। সে-তো কেবল ওই হৃদয়েই স্থান পায় যা
শূন্য, দুর্বল, পরাস্ত। এধরনের হৃদয়েই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ভালোবাসা
স্থান পায়। আর এটা যখন শক্তিশালী পর্যায়ে পৌঁছে, প্রকট আকার ধারণ করে তখন
কখনো আল্লাহর ভালোবাসাকেও অতিক্রম করে যায় এবং ব্যক্তিকে শিরকের দিকে
ঠেলে দেয়। এজন্যই বলা হয়েছে, প্রেমপ্রীতি শূন্য হৃদয়ের আন্দোলন।
হৃদয়
যখন আল্লাহর মহব্বত ও স্মরণ থেকে শূন্য হয়ে যায়, আল্লাহর কাছে
দুয়া-মুনাজাত ও আল্লাহর কালামের স্বাদ গ্রহণ করা থেকে যখন শূন্য হয়ে যায়
তখন নারীর ভালোবাসা, ছবির প্রতি আগ্রহ, গান-বাজনা শোনার আগ্রহ তার জায়গা
দখল করে।
শায়খ ইবনে তাইমিয়াহ রা. বলেন: [দ্র:মাজমুউল
ফাতওয়া: ১০/১৩৫] হৃদয় যদি একমাত্র আল্লাহকে ভালবাসে, দীনকে একমাত্র তার
জন্য একনিষ্ঠ করে, তাহলে অন্য কারও ভালোবাসার মুসীবত তাকে স্পর্শ করতে পারে
না। প্রেম-ভালোবাসার কথা তো বহু দূরে। প্রেম-ভালোবাসায় লিপ্ত হওয়ার
অর্থ, হৃদয়ে আল্লাহর মহব্বতের অপূর্ণতা। এ-কারণে ইউসুফ আলাইহিস সালাম,
যিনি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে মহব্বত করতেন, তিনি এই মানবীয় ইশক-মহব্বত থেকে
বেঁচে গেছেন। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
(এমনি ভাবেই হয়েছে যাতে আমি তার থেকে মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয় সরিয়ে দেই। নিশ্চয় সে আমার মনোনীত বান্দাদের মধ্যে একজন ছিল।) [ সূরা ইউসূফ: ২৪]
পক্ষান্তরে মিসরের প্রধানের স্ত্রী ও সম্প্রদায় ছিল মুশরিক। ফলে সে প্রেম-ভালোবাসায় আক্রান্ত হয়।‘
(এমনি ভাবেই হয়েছে যাতে আমি তার থেকে মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয় সরিয়ে দেই। নিশ্চয় সে আমার মনোনীত বান্দাদের মধ্যে একজন ছিল।) [ সূরা ইউসূফ: ২৪]
পক্ষান্তরে মিসরের প্রধানের স্ত্রী ও সম্প্রদায় ছিল মুশরিক। ফলে সে প্রেম-ভালোবাসায় আক্রান্ত হয়।‘
তাই
একজন মুসলমানের উচিত এই ধ্বংসের পথ থেকে সরে আসা। এ থেকে নিজেকে রক্ষা করা
ও নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। যদি এ-ক্ষেত্রে
ঢিল দেয়, বা কোতাহি করে এবং প্রেমের নদীতে তরী ভাসায় - যার প্রতি দৃষ্টি
দেয়া হারাম তাকে বার বার দেখে দেখে, যা শোনা হারাম তা বার বার শোনে শোনে,
বিপরীত লিঙ্গের সাথে কথা বলাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে করে, আর এভাবেই ডুবে যায়
প্রেম-ভালোবাসায়, তাহলে সে নিশ্চয় গুনাগার, পাপী, শাস্তি ও আযাবে
উপযোগী।
এমন
অনেক মানুষ আছে যে শুরুতে ঢিল দিয়েছে, মনে করেছে যখন ইচ্ছে করবে ফিরে
আসতে পারবে, নিজেকে মুক্ত করতে পারবে, অথবা বিশেষ সীমানা পর্যন্তই যাবে।
তবে যখন ব্যাধি রগরেশায় অনুপ্রবেশ করেছে, তখন না কাজে এসেছে কোনো ডাক্তারে
আর না কোনো ওষুধে।
কবি বলেন:
প্রেম প্রেম খেলেছে
এক পর্যায়ে বনে গেছে প্রেমিক,
তারপর প্রেম যখন তাকে করেছে বিজয়
হয়েছে সে অপারগ,
ভ্রম হয়েছে বিশাল ঢেউকে ছোট্ট বলে,
ফলে যখন দাঁড়িয়েছে তাতে শক্তভাবে,
গিয়েছে সে চির নিমজ্জনে।
রাওজাতুল মুহিব্বিন গ্রন্থে ইবনেল কাইয়েম রা. বলেন :
[ দ্র:পৃষ্ঠা: ১৪৭] ’যখন কারণটা তার ইচ্ছায় সংঘটিত হয়েছে, তখন এর থেকে
তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও যা জন্ম নেবে সে ব্যাপারে সে মাযুর নয়, তথা উযর পেশ
করার অধিকার সে হারিয়ে ফেলে। আর এতে সন্দেহ নেই যে বার বার দৃষ্টিনিক্ষেপ
করা এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করে যাওয়া মাদক সেবনের মতোই, অর্থাৎ
ব্যক্তিকে কারণ সংঘটিত করার অপরাধেই কেবল অভিযুক্ত করা হয়। ‘
ব্যক্তি
যদি এই মারাত্মক ব্যাধি থেকে দূরে থাকার জন্য আগ্রহী হয়, অতঃপর সে হারাম
জিনিস দেখা থেকে দৃষ্টিকে ফিরিয়ে রাখে, হারাম জিনিস শোনা থেকে কান বন্ধ
করে রাখে, মনের মধ্যে শয়তান যে কুমন্ত্রণা দেয় তা দূরে সরিয়ে দেয়, এর
পরেও যদি এই ব্যাধির অগ্নিকণা তাকে স্পর্শ করে-ক্ষণিক দৃষ্টির কারণে, অথবা
এমন কোনো লেনদেনের কারণে যা মূলতঃ বৈধ ছিল- অতঃপর এভাবে যদি কোনো নারীর
প্রতি মহব্বত জন্মে যায়, তাহলে আশা করা যায় কোনো গুনাহ হবে না,
ইনশাআল্লাহ। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
(আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের ভার দেন না) [ সূরা আল বাকারা: ২৮৬]
(আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের ভার দেন না) [ সূরা আল বাকারা: ২৮৬]
ইবনে তাইমিয়াহ রা. মাজমুউল ফাতওয়ায় বলেন: [ দ্র:১১/১০]’ যদি ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোনো বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন না হয়, তাহলে, তাকে যা পেয়ে বসল তাতে গুনাহ হবে না।‘
ইবনেল কাইয়েম রা. বলেন: [
দ্র: রাউযাতুল মুহিব্বিন:১৪৭]’যদি, অবৈধ নয় এমন কারণ হেতু প্রেম জন্ম
নেয়, তাহলে ব্যক্তিকে দোষারোপ করা হবে না। যেমন কেউ তার স্ত্রী অথবা দাসীর
প্রেমাক্রান্ত ছিল, অতঃপর যেকোনো কারণে তাদের বিচ্ছেদ ঘটল, কিন্তু প্রেমের
ভাব থেকে সে নিষ্কৃতি পেল না, এমতাবস্থায় তাকে দোষারোপ করা হবে না।
অনুরূপভাবে যদি হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে যায় এবং সে সাথে সাথে দৃষ্টি সরিয়ে
নেয়, কিন্তু অনিচ্ছাকৃতভাবেই তার হৃদয় প্রেমাক্রান্ত হয়, তাহলেও তাকে
দোষারোপ করা যাবে না। তবে তাকে অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে দমন করার জন্য এবং
তা থেকে সরে আসার জন্য।‘
ব্যক্তিকে
চেষ্টা করে যেতে হবে তার হৃদয়ের চিকিৎসার জন্য প্রীতিভাজনের সকল স্মৃতি
থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে- আল্লাহর মহব্বত দিয়ে নিজ হৃদয়কে ভরপুর
করে, আল্লাহর মহব্বত আঁক্ড়ে ধরে নিজেকে অমুখাপেক্ষী করে। আর যারা
বুদ্ধিমান ও আমানতদার নসিহতকারী এমন ব্যক্তিদের পরামর্শ নিতেও সঙ্কোচবোধ
করবে না, অথবা মনোচিকিৎসকদের শরণাপন্ন হতেও ভুলবে না। তাদের কাছে হয়তো
কোনো এলাজ পাওয়া যেতে পারে। এর পাশাপাশি সে হবে ধৈর্যশীল, আল্লাহর কাছে
ছাওয়াব প্রার্থী, পবিত্রতা অবলম্বনকারী, গোপনকারী। এরূপ করলে আল্লাহ তার
জন্য ছাওয়াব লিখবেন ইনশা আল্লাহ।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রা. বলেন: [
দ্র: মাজমুউল ফাতওয়া:১০/১৩৩]’যদি ব্যক্তি প্রেমাক্রান্ত হয়, অতঃপর সে
পবিত্রতা অবলম্বন করে, ধৈর্য ধরে, তাহলে আল্লাহ তার তাকওয়ার জন্য ছাওয়াব
দেবেন। কেননা শরিয়তের দলিল থেকে জানা যায়, ব্যক্তি যদি দৃষ্টি-কথা-কর্মের
ক্ষেত্রে হারাম বিষয় থেকে বেঁচে থাকে, আর ব্যাপারটা ফাঁস্ করে না দিয়ে
গোপন করে, কোনো মাখলুকের কাছে শিকায়েত করতে গিয়ে হারাম কথায় জড়িয়ে না
যায়, সে যদি কোনো নির্লজ্জ বিষয় ফাঁস্ না করে দেয়, প্রীতিভাজনের
অন্বেষণে বের না হয়, আল্লাহর আনুগত্য ও পাপ থেকে ধৈর্য ধরে, তার হৃদয়ে যে
প্রেমযন্ত্রণা রয়েছে তার ক্ষেত্রেও ধৈর্য ধরে, যেভাবে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি
বিপদে ধৈর্য ধরে, তাহলে আল্লাহকে ভয়কারী ও ধৈর্যধারণকারীদের মধ্যে সে
শামিল হবে। ইরশাদ হয়েছে:
(নিশ্চয় যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করে ও সবর করে, নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না।‘
(নিশ্চয় যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করে ও সবর করে, নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না।‘
আল্লাহই ভালো জানেন
সমাপ্ত
মুফতী: শায়খ মুহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ
সূত্র: http://www.islamqa.info
0 Comments