لاَ تَدْخُلُوا مَسَاكِنَ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ إِلاَّ أَنْ تَكُونُوا بَاكِيْنَ أَنْ يُصِيبَكُمْ مَا أَصَابَهُمْ-
‘তোমরা ঐসব অভিশপ্তদের এলাকায় প্রবেশ করো না ক্রন্দনরত অবস্থায় ব্যতীত। যদি
ক্রন্দন করতে না পার, তাহ’লে প্রবেশ করো না। তাহ’লে তোমাদের উপর ঐ গযব
আসতে পারে, যা তাদের উপর এসেছিল’।[2] রাসূলের এই বক্তব্যের মধ্যে সুক্ষ্ম
তাৎপর্য এই যে, এগুলি দেখে যদি মানুষ আল্লাহর গযবে ভীত না হয়, তাহ’লে তাদের
অন্তর শক্ত হয়ে যাবে এবং ঐসব অভিশপ্তদের মত অহংকারী ও হঠকারী আচরণ করবে।
ফলে তাদের উপর অনুরূপ গযব নেমে আসবে, যেরূপ ইতিপূর্বে ঐসব অভিশপ্তদের উপর
নেমে এসেছিল।
পার্থিব বিত্ত-বৈভব ও ধনৈশ্বর্যের পরিণতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অশুভ হয়ে থাকে।
বিত্তশালীরা আল্লাহ ও আখেরাতকে ভুলে গিয়ে ভ্রান্ত পথে পা বাড়ায়। ছামূদ
জাতির বেলায়ও তাই হয়েছিল। অথচ কওমে নূহের কঠিন শাস্তির ঘটনাবলী তখনও
লোকমুখে আলোচিত হ’ত। আর কওমে ‘আদ-এর নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঘটনা তো তাদের কাছে
একপ্রকার টাটকা ঘটনাই ছিল। অথচ তাদের ভাইদের ধ্বংসস্ত্তপের উপরে বড় বড়
বিলাসবহুল অট্টালিকা নির্মাণ করে ও বিত্ত বৈভবের মালিক হয়ে তারা পিছনের কথা
ভুলে গেল। এমনকি তারা ‘আদ জাতির মত অহংকারী কার্যকলাপ শুরু করে দিল। তারা
শিরক ও মূর্তিপূজায় লিপ্ত হ’ল। এমতাবস্থায় তাদের হেদায়াতের জন্য তাদেরই
বংশের মধ্য হ’তে ছালেহ (আঃ)-কে আল্লাহ নবী মনোনীত করে পাঠালেন।
কওমে ছামূদ-এর প্রতি হযরত ছালেহ (আঃ)-এর দাওয়াত :
পথভোলা জাতিকে হযরত ছালেহ (আঃ) সর্বপ্রথম তাওহীদের দাওয়াত দিলেন। তিনি
তাদেরকে মূর্তিপূজাসহ যাবতীয় শিরক ও কুসংস্কার ত্যাগ করে এক আললাহর ইবাদত ও
তাঁর প্রেরিত বিধান সমূহের প্রতি আনুগত্যের আহবান জানালেন। তিনি যৌবনকালে
নবুঅতপ্রাপ্ত হন। তখন থেকে বার্ধক্যকাল অবধি তিনি স্বীয় কওমকে নিরন্তর
দাওয়াত দিতে থাকেন। কওমের দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা তাঁর উপরে ঈমান আনলেও
শক্তিশালী ও নেতৃস্থানীয় লোকেরা তাঁকে অস্বীকার করে। ছালেহ (আঃ)-এর দাওয়াত
সম্পর্কে সূরা আ‘রাফের ৭৩-৭৯ আয়াতে আল্লাহ বলেন,
وَإِلَى ثَمُوْدَ أَخَاهُمْ صَالِحاً قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللهَ مَا
لَكُم مِّنْ إِلَـهٍ غَيْرُهُ قَدْ جَاءتْكُمْ بَيِّنَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ
هَـذِهِ نَاقَةُ اللهِ لَكُمْ آيَةً فَذَرُوْهَا تَأْكُلْ فِيْ أَرْضِ
اللهِ وَلاَ تَمَسُّوْهَا بِسُوْءٍ فَيَأْخُذَكُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ،
وَاذْكُرُوْا إِذْ جَعَلَكُمْ خُلَفَاءَ مِنْ بَعْدِ عَادٍ وَبَوَّأَكُمْ
فِي الأَرْضِ تَتَّخِذُوْنَ مِنْ سُهُوْلِهَا قُصُوْراً وَتَنْحِتُوْنَ
الْجِبَالَ بُيُوْتاً فَاذْكُرُوْا آلآءَ اللهِ وَلاَ تَعْثَوْا فِي
الأَرْضِ مُفْسِدِيْنَ، قَالَ الْمَلأُ الَّذِيْنَ اسْتَكْبَرُوْا مِنْ
قَوْمِهِ لِلَّذِيْنَ اسْتُضْعِفُوْا لِمَنْ آمَنَ مِنْهُمْ أَتَعْلَمُوْنَ
أَنَّ صَالِحاً مُّرْسَلٌ مِّن رَّبِّهِ قَالُوْا إِنَّا بِمَا أُرْسِلَ
بِهِ مُؤْمِنُوْنَ، قَالَ الَّذِيْنَ اسْتَكْبَرُوْا إِنَّا بِالَّذِيْ
آمَنتُمْ بِهِ كَافِرُوْنَ، فَعَقَرُوا النَّاقَةَ وَعَتَوْا عَنْ أَمْرِ
رَبِّهِمْ وَقَالُوا يَا صَالِحُ ائْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ
مِنَ الْمُرْسَلِيْنَ، فَأَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ فَأَصْبَحُوْا فِيْ
دَارِهِمْ جَاثِمِيْنَ، فَتَوَلَّى عَنْهُمْ وَقَالَ يَا قَوْمِ لَقَدْ
أَبْلَغْتُكُمْ رِسَالَةَ رَبِّيْ وَنَصَحْتُ لَكُمْ وَلَكِن لاَّ
تُحِبُّوْنَ النَّاصِحِيْنَ- (الأعراف ৭৩-৭৯)-
অনুবাদ: ‘ছামূদ জাতির নিকটে (আমরা প্রেরণ করেছিলাম) তাদের ভাই ছালেহকে। সে
বলল, হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন
উপাস্য নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ হ’তে একটি প্রমাণ এসে
গেছে। এটি আল্লাহর উষ্ট্রী, তোমাদের জন্য নিদর্শন স্বরূপ। অতএব তোমরা একে
ছেড়ে দাও আল্লাহর যমীনে চরে বেড়াবে। তোমরা একে অন্যায়ভাবে স্পর্শ করবে না।
তাতে মর্মান্তিক শাস্তি তোমাদের পাকড়াও করবে’ (আ‘রাফ ৭/৭৩)। ‘তোমরা স্মরণ
কর, যখন আল্লাহ তোমাদেরকে ‘আদ জাতির পরে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেন এবং
তোমাদেরকে পৃথিবীতে ঠিকানা করে দেন। সেমতে তোমরা সমতল ভূমিতে অট্টালিকা
সমূহ নির্মাণ করেছ এবং পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে প্রকোষ্ঠ সমূহ নির্মাণ করেছ।
অতএব তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ সমূহ স্মরণ কর এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করো
না’ (৭৪)। কিন্তু তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক নেতারা ঈমানদার দুর্বল শ্রেণীর
উদ্দেশ্যে বলল, ‘তোমরা কি জানো যে, ছালেহ তার প্রভুর পক্ষ হ’তে প্রেরিত
নবী? তারা বলল, আমরা তো তার আনীত বিষয় সমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী’
(৭৫)। ‘(জবাবে) দাদ্ভিক নেতারা বলল, তোমরা যে বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করেছ,
আমরা সে বিষয়ে অস্বীকারকারী’ (৭৬)। ‘অতঃপর তারা উষ্ট্রীকে হত্যা করল এবং
তাদের প্রভুর আদেশ অমান্য করল। তারা বলল, হে ছালেহ! তুমি নিয়ে এস যদ্বারা
তুমি আমাদের ভয় দেখাতে, যদি তুমি আল্লাহর প্রেরিত নবীদের একজন হয়ে থাক’
(৭৭)। ‘অতঃপর ভূমিকম্প তাদের পাকড়াও করল এবং সকাল বেলা নিজ নিজ গৃহে সবাই
উপুড় হয়ে পড়ে রইল’ (৭৮)। ‘ছালেহ তাদের কাছ থেকে প্রস্থান করল এবং বলল, হে
আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদের কাছে আমার প্রতিপালকের পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি এবং
তোমাদের কল্যাণ কামনা করেছি। কিন্তু তোমরা কল্যাণকামীদের ভালবাস না’
(আ‘রাফ ৭/৭৩-৭৯)।
ছালেহ (আঃ)-এর উপরোক্ত দাওয়াত ও তাঁর কওমের আচরণ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ২২টি সূরায় ৮৭টি আয়াতে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে।[3]
ছালেহ (আঃ)-এর দাওয়াতের ফলশ্রুতি :
ইতিপূর্বেকার ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলির ন্যায় কওমে ছামূদও তাদের নবী হযরত
ছালেহ (আঃ)-কে অমান্য করে। তারা বিগত ‘আদ জাতির ন্যায় পৃথিবীতে অনর্থ
সৃষ্টি করতে থাকে। নবী তাদেরকে যতই দাওয়াত দিতে থাকেন, তাদের অবাধ্যতা ততই
সীমা লংঘন করতে থাকে। ‘তারা বলল,
قَالُوْا يَا صَالِحُ قَدْ كُنْتَ فِيْنَا مَرْجُوًّا قَبْلَ هَذَا
أَتَنْهَانَا أَن نَّعْبُدَ مَا يَعْبُدُ آبَاؤُنَا وَإِنَّنَا لَفِيْ
شَكٍّ مِّمَّا تَدْعُوْنَا إِلَيْهِ مُرِيْبٍ- (هود ৬২)-
হে ছালেহ! ইতিপূর্বে আপনি আমাদের কাছে আকাংখিত ব্যক্তি ছিলেন। আপনি কি
বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা উপাস্যদের পূজা করা থেকে আমাদের নিষেধ করছেন?
অথচ আমরা আপনার দাওয়াতের বিষয়ে যথেষ্ট সন্দিহান’ (হূদ ১১/৬২)। তারা কওমের
দুর্বল ও দরিদ্র শ্রেণীর লোকদের জমা করে বলল,أَتَعْلَمُوْنَ أَنَّ صَالِحاً
مُّرْسَلٌ مِّن رَّبِّهِ- ‘তোমরা কি বিশ্বাস কর যে, ছালেহ তার প্রভুর পক্ষ
হ’তে প্রেরিত ব্যক্তি’? তারা জবাব দিল, ِإِنَّابِمَا أُرْسِلَ بِهِ
مُؤْمِنُوْنَ- ‘আমরা তো তাঁর আনীত বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী’। একথা
শুনে দাম্ভিক নেতারা ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠল, ‘তোমরা যে বিষয়ে ঈমান এনেছ, আমরা
ঐসব কিছুকে অস্বীকার করি’ (আ‘রাফ ৭/৭৫)। তারা আরও বলল,
فَقَالُوا أَبَشَرًا مِّنَّا وَاحِدًا نَّتَّبِعُهُ إِنَّا إِذًا لَّفِيْ
ضَلاَلٍ وَسُعُرٍ- أَؤُلْقِيَ الذِّكْرُ عَلَيْهِ مِن بَيْنِنَا بَلْ هُوَ
كَذَّابٌ أَشِرٌ- (القمر ২৪-২৫)-
‘আমরা কি আমাদেরই একজনের অনুসরণ করব? তাহ’লে তো আমরা বিপথগামী ও
বিকারগ্রস্ত বলে গণ্য হব’। ‘আমাদের মধ্যে কি কেবল তারই উপরে অহী নাযিল করা
হয়েছে? আসলে সে একজন মহা মিথ্যাবাদী ও দাম্ভিক’ (ক্বামার ৫৪/২৪-২৫)। তারা
ছালেহকে বলল, قَالُوا اطَّيَّرْنَا بِكَ وَبِمَن مَّعَكَ ...- ‘আমরা তোমাকে
ও তোমার সাথে যারা আছে তাদেরকে অকল্যাণের প্রতীক মনে করি’... (নামল
২৭/৪৭)। এইভাবে সমাজের শক্তিশালী শ্রেণী তাদের নবীকে অমান্য করল এবং
মূর্তিপূজা সহ নানাবিধ শিরক ও কুসংস্কারে লিপ্ত হ’ল এবং সমাজে অনর্থ সৃষ্টি
করতে থাকল। আল্লাহর ভাষায়, فَاسْتَحَبُّوا الْعَمَى عَلَى الْهُدَى
فَأَخَذَتْهُمْ صَاعِقَةُ الْعَذَابِ الْهُوْنِ بِمَا كَانُوْا
يَكْسِبُوْنَ- ‘তারা হেদায়াতের চাইতে অন্ধত্বকেই পসন্দ করে নিল। অতঃপর
তাদের কৃতকর্মের ফলে অবমাননাকর শাস্তির গর্জন এসে তাদের পাকড়াও করল’
(ফুছছিলাত/হামীম সাজদাহ ৪১/১৭)।
কওমে ছামূদ-এর উপরে আপতিত গযবের বিবরণ :
ইবনু কাছীর বর্ণনা করেন যে, হযরত ছালেহ (আঃ)-এর নিরন্তর দাওয়াতে অতিষ্ঠ হয়ে
সম্প্রদায়ের নেতারা স্থির করল যে, তাঁর কাছে এমন একটা বিষয় দাবী করতে হবে,
যা পূরণ করতে তিনি ব্যর্থ হবেন এবং এর ফলে তাঁর দাওয়াতও বন্ধ হয়ে যাবে।
সেমতে তারা এসে তাঁর নিকটে দাবী করল যে, আপনি যদি আল্লাহর সত্যিকারের নবী
হন, তাহ’লে আমাদেরকে নিকটবর্তী ‘কাতেবা’ পাহাড়ের ভিতর থেকে একটি দশ মাসের
গর্ভবতী সবল ও স্বাস্থ্যবতী উষ্ট্রী বের করে এনে দেখান।
এ দাবী শুনে হযরত ছালেহ (আঃ) তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলেন যে, যদি
তোমাদের দাবী পুরণ করা হয়, তবে তোমরা আমার নবুঅতের প্রতি ও আমার দাওয়াতের
প্রতি ঈমান আনবে কি-না। জেনে রেখ, উক্ত মু‘জেযা প্রদর্শনের পরেও যদি তোমরা
ঈমান না আনো, তাহ’লে আল্লাহর গযবে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে’। এতে সবাই স্বীকৃত
হ’ল ও উক্ত মর্মে অঙ্গীকার করল। তখন ছালেহ (আঃ) ছালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং
আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ পাক তার দো‘আ কবুল করলেন এবং বললেন,
إِنَّا مُرْسِلُو النَّاقَةِ فِتْنَةً لَّهُمْ فَارْتَقِبْهُمْ
وَاصْطَبِرْ ‘আমরা তাদের পরীক্ষার জন্য একটি উষ্ট্রী প্রেরণ করব। তুমি
তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখ এবং ধৈর্য ধারণ কর’ (ক্বামার ৫৪/২৭)। কিছুক্ষণের
মধ্যেই পাহাড়ের গায়ে কম্পন দেখা দিল এবং একটি বিরাট প্রস্তর খন্ড বিস্ফোরিত
হয়ে তার ভিতর থেকে কওমের নেতাদের দাবীর অনুরূপ একটি গর্ভবতী ও লাবণ্যবতী
তরতাযা উষ্ট্রী বেরিয়ে এল।
ছালেহ (আঃ)-এর এই বিস্ময়কর মু‘জেযা দেখে গোত্রের নেতা সহ তার সমর্থক লোকেরা
সাথে সাথে মুসলমান হয়ে গেল। অবশিষ্টরাও হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করল। কিন্তু
প্রধান ধর্মনেতা ও অন্যান্য সমাজ নেতাদের বাধার কারণে হ’তে পারল না। তারা
উল্টা বলল, قَالُوا اطَّيَّرْنَا بِكَ وَبِمَن مَّعَكَ ...- ‘আমরা তোমাকে ও
তোমার সাথে যারা আছে তাদেরকে অকল্যাণের প্রতীক মনে করি...’ (নামল ২৭/৪৭)।
হযরত ছালেহ (আঃ) কওমের নেতাদের এভাবে অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে দেখে এবং পাল্টা
তাঁকেই দায়ী করতে দেখে দারুণভাবে শংকিত হ’লেন যে, যেকোন সময়ে এরা আল্লাহর
গযবে ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি তাদেরকে সাবধান করে বললেন, قَالَ طَائِرُكُمْ
عِنْدَ اللَّهِ بَلْ أَنتُمْ قَوْمٌ تُفْتَنُوْنَ- ‘দেখ, তোমাদের
মঙ্গলামঙ্গল আল্লাহর নিকটে রয়েছে। বরং তোমরা এমন সম্প্রদায়, যাদেরকে
পরীক্ষা করা হচ্ছে’ (নামল ২৭/৪৭)। অতঃপর পয়গম্বরসূলভ দয়া প্রকাশ করে বললেন,
هَـذِهِ نَاقَةُ اللّهِ لَكُمْ آيَةً فَذَرُوْهَا تَأْكُلْ فِيْ أَرْضِ
اللّهِ وَلاَ تَمَسُّوْهَا بِسُوْءٍ فَيَأْخُذَكُمْ عَذَابٌ قَرِيْبٌ- (هود
৬৪)-
‘এটি আল্লাহর উষ্ট্রী। তোমাদের জন্য নিদর্শন স্বরূপ। একে আল্লাহর যমীনে
স্বাধীনভাবে চরে বেড়াতে দাও। সাবধান! একে অসৎ উদ্দেশ্যে স্পর্শ করো না।
তাহ’লে তোমাদেরকে সত্বর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি পাকড়াও করবে’ (হূদ ১১/৬৪)।
আল্লাহ উক্ত উষ্ট্রীর জন্য এবং লোকদের জন্য পানি বণ্টন করে দিয়েছিলেন। তিনি
নবীকে বলে দেন, َنَبِّئْهُمْ أَنَّ الْمَاءَ قِسْمَةٌ بَيْنَهُمْ كُلُّ
شِرْبٍ مُّحْتَضَرٌ ‘হে ছালেহ! তুমি ওদেরকে বলে দাও যে, কূপের পানি তাদের
মধ্যে বণ্টিত হয়েছে। প্রত্যেক পালায় তারা হাযির হবে’ (ক্বামার ৫৪/২৮)।
لَّهَا شِرْبٌ وَلَكُمْ شِرْبُ يَوْمٍ مَّعْلُوْمٍ- ‘একদিন উষ্ট্রীর ও পরের
দিন তোমাদের (পানি পানের) জন্য পালা নির্ধারিত হয়েছে’ (ক্বামার ৫৪/২৮;
শো‘আরা ২৬/১৫৫)।
আল্লাহ তা‘আলা কওমে ছামূদ-এর জন্য উক্ত উষ্ট্রীকেই সর্বশেষ পরীক্ষা হিসাবে
নির্ধারণ করেছিলেন। তিনি বলেন, وَآتَيْنَا ثَمُوْدَ النَّاقَةَ مُبْصِرَةً
فَظَلَمُوْا بِهَا وَمَا نُرْسِلُ بِالآيَاتِ إِلاَّ تَخْوِيْفًا- ‘আর আমরা
ছামূদকে উষ্ট্রী দিয়েছিলাম স্পষ্ট নিদর্শন হিসাবে। কিন্তু তারা তার প্রতি
যুলুম করেছিল। বস্ত্ততঃ আমরা ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই নিদর্শন সমূহ
প্রেরণ করে থাকি’ (ইসরা ১৭/৫৯)।
ছামূদ জাতির লোকেরা যে কূপ থেকে পানি পান করত ও তাদের গবাদি পশুদের পানি
পান করাত, এ উষ্ট্রীও সেই কূপ থেকে পানি পান করত। উষ্ট্রী যেদিন পানি পান
করত, সেদিন কূয়ার পানি নিঃশেষে পান করে ফেলত। অবশ্য ঐদিন লোকেরা উষ্ট্রীর
দুধ পান করত এবং বাকী দুধ দ্বারা তাদের সব পাত্র ভরে নিত। কিন্তু এই
হতভাগাদের কপালে এত সুখ সহ্য হ’ল না। তারা একদিন পানি না পাওয়াকে অসুবিধার
কারণ হিসাবে গণ্য করল। তাছাড়া উষ্ট্রী যখন ময়দানে চরে বেড়াত, তখন তার বিশাল
দেহ ও অপরূপ চেহারা দেখে অন্যান্য গবাদি পশু ভয় পেত। ফলে তারা উষ্ট্রীকে
মেরে ফেলতে মনস্থ করল। কিন্তু আল্লাহর গযবের ভয়ে কেউ সাহস করল না।
ইবনু জারীর প্রমুখ মুফাসসিরগণের বর্ণনা মতে, অবশেষে শয়তান তাদেরকে সর্ববৃহৎ
কুমন্ত্রণা দিল। আর তা হ’ল নারীর প্রলোভন। ছামূদ গোত্রের দু’জন পরমা
সুন্দরী মহিলা, যারা ছালেহ (আঃ)-এর প্রতি দারুণ বিদ্বেষী ছিল, তারা তাদের
রূপ-যৌবন দেখিয়ে দু’জন পথভ্রষ্ট যুবককে উষ্ট্রী হত্যায় রাযী করালো। অতঃপর
তারা তীর ও তরবারির আঘাতে উষ্ট্রীকে পা কেটে হত্যা করে ফেলল। হত্যাকারী
যুবকদ্বয়ের প্রধানকে লক্ষ্য করেই কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, إِذِ انْبَعَثَ
أَشْقَاهَا ‘যখন তাদের সবচেয়ে হতভাগা লোকটি তৎপর হয়ে উঠেছিল’ (শাম্স
৯১/১২)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা খুৎবায় উক্ত আয়াত পাঠ করে বলেন, ঐ লোকটি
ছিল কঠোর হৃদয় ও দুশ্চরিত্র (رجل عزيز عارم )।[4] কেননা তার কারণেই গোটা
ছামূদ জাতি গযবে পতিত হয়। আল্লাহ বলেন,
فَنَادَوْا صَاحِبَهُمْ فَتَعَاطَى فَعَقَرَ، فَكَيْفَ كَانَ عَذَابِي
وَنُذُرِ، إِنَّا أَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ صَيْحَةً وَاحِدَةً فَكَانُوْا
كَهَشِيْمِ الْمُحْتَظِرِ-
‘অতঃপর তারা তাদের প্রধান ব্যক্তিকে ডাকল। অতঃপর সে উষ্ট্রীকে ধরল ও বধ
করল’ (২৯)। ‘অতঃপর কেমন কঠোর ছিল আমার শাস্তি ও ভীতি প্রদর্শন! (৩০)। ‘আমরা
তাদের প্রতি প্রেরণ করলাম একটিমাত্র নিনাদ। আর তাতেই তারা হয়ে গেল খোয়াড়
মালিকের চূর্ণিত শুষ্ক খড়কুটো সদৃশ’ (ক্বামার ৫৪/২৯-৩১)।
উল্লেখ্য যে, উষ্ট্রী হত্যার ঘটনার পর ছালেহ (আঃ) স্বীয় কওমকে আল্লাহর
নির্দেশ জানিয়ে দিলেন যে, تَمَتَّعُوْا فِيْ دَارِكُمْ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ
ذَلِكَ وَعْدٌ غَيْرُ مَكْذُوْبٍ- ‘এখন থেকে তিনদিন তোমরা তোমাদের ঘরে আরাম
করে নাও (এর পরেই আযাব নেমে আসবে)। এ ওয়াদার (অর্থাৎ এ সময়সীমার) কোন
ব্যতিক্রম হবে না’ (হূদ ১১/৬৫)। কিন্তু এই হতভাগারা এরূপ কঠোর হুঁশিয়ারির
কোন গুরুত্ব না দিয়ে বরং তাচ্ছিল্যভরে বলল, يَا صَالِحُ ائْتِنَا بِمَا
تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الْمُرْسَلِيْنَ ‘হে ছালেহ! তুমি যার ভয়
দেখাচ্ছ, তা নিয়ে আস দেখি, যদি তুমি সত্যিকারের নবী হয়ে থাক’ (আ‘রাফ ৭/৭৭)।
তারা বলল, আমরা জানতে চাই, এ শাস্তি কিভাবে আসবে, কোত্থেকে আসবে, এর লক্ষণ
কি হবে? ছালেহ (আঃ) বললেন, আগামীকাল বৃহষ্পতিবার তোমাদের সকলের মুখমন্ডল
হলুদ হয়ে যাবে। পরের দিন শুক্রবার তোমাদের সবার মুখমন্ডল লালবর্ণ ধারণ
করবে। অতঃপর শনিবার দিন সবার মুখমন্ডল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হয়ে যাবে। এটাই হবে
তোমাদের জীবনের শেষ দিন।[5]
একথা শোনার পর হঠকারী জাতি আল্লাহর নিকটে তওবা করে ক্ষমা প্রার্থনার
পরিবর্তে স্বয়ং ছালেহ (আঃ)-কেই হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ভাবল, যদি
আযাব এসেই যায়, তবে তার আগে একেই শেষ করে দিই। কেননা এর নবুঅতকে অস্বীকার
করার কারণেই গযব আসছে। অতএব এই ব্যক্তিই গযবের জন্য মূলতঃ দায়ী। আর যদি গযব
না আসে, তাহ’লে সে মিথ্যার দন্ড ভোগ করুক’। কওমের নয়জন নেতা এ নিকৃষ্ট
ষড়যন্ত্রের নেতৃত্ব দেয়। তাদের এই চক্রান্তের বিষয় সূরা নমলে বর্ণিত হয়েছে
এভাবে যে,
وَكَانَ فِي الْمَدِيْنَةِ تِسْعَةُ رَهْطٍ يُفْسِدُوْنَ فِي الْأَرْضِ
وَلاَ يُصْلِحُوْنَ، قَالُوْا تَقَاسَمُوْا بِاللَّهِ لَنُبَيِّتَنَّـهُ
وَأَهْلَهُ ثُمَّ لَنَقُولَنَّ لِوَلِيِّهِ مَا شَهِدْنَا مَهْلِكَ
أَهْلِهِ وَإِنَّا لَصَادِقُوْنَ-(نمل ৪৮-৪৯)-
‘সেই শহরে ছিল এমন নয় ব্যক্তি, যারা জনপদে অনর্থ সৃষ্টি করে বেড়াত এবং
কোনরূপ সংশোধনমূলক কাজ তারা করত না’ (৪৮)। ‘তারা বলল, তোমরা পরস্পরে
আল্লাহর নামে শপথ কর যে, আমরা রাত্রিকালে ছালেহ ও তার পরিবার বর্গকে হত্যা
করব। অতঃপর তার রক্তের দাবীদারকে আমরা বলে দেব যে, আমরা এ হত্যাকান্ড
প্রত্যক্ষ করিনি। আর আমরা নিশ্চিতভাবে সত্যবাদী’ (নমল ২৭/৪৮-৪৯)।
তারা যুক্তি দিল, আমরা আমাদের কথায় অবশ্যই সত্যবাদী প্রমাণিত হব। কারণ
রাত্রির অন্ধকারে কে কাকে মেরেছে, তা আমরা নির্দিষ্টভাবে জানতে পারব না।
নেতৃবৃন্দের এ সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ও চক্রান্ত অনুযায়ী নয় নেতা তাদের
প্রধান ক্বাদার বিন সালেফ-এর নেতৃত্বে রাতের বেলা ছালেহ (আঃ)-কে হত্যা করার
জন্য তাঁর বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’ল। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা পথিমধ্যেই
তাদেরকে প্রস্তর বর্ষণে ধ্বংস করে দিলেন। আল্লাহ বলেন,
وَمَكَرُوْا مَكْرًا وَمَكَرْنَا مَكْرًا وَهُمْ لاَ يَشْعُرُوْنَ،
فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ مَكْرِهِمْ أَنَّا دَمَّرْنَاهُمْ
وَقَوْمَهُمْ أَجْمَعِيْنَ- (نمل ৫০-৫১)-
‘তারা ষড়যন্ত্র করল। আমরাও পাল্টা কৌশল করলাম। অথচ তারা কিছুই জানতে পারল
না’। ‘তাদের চক্রান্তের পরিণতি দেখ। আমরা অবশ্যই তাদেরকে ও তাদের
সম্প্রদায়ের সবাইকে ধ্বংস করে দিয়েছিলাম’ (নমল ২৭/৫০-৫১)।
উল্লেখ্য যে, কুরআনে ঐ নয় ব্যক্তিকে تِسْعَةُ رَهْطٍ বা ‘নয়টি দল’ বলা
হয়েছে। এতে বুঝা যায় যে, ওরা নয়জন নয়টি দলের নেতা ছিল এবং তারা ছিল হিজ্র
জনপদের প্রধান নেতৃবৃন্দ (ইবনু কাছীর, সূরা নমল, ঐ)।
উপরোক্ত চক্রান্তের ঘটনায় একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, জাতির শীর্ষ দুষ্টমতি
নেতারা কুফর, শিরক, হত্যা-সন্ত্রাস ও ডাকাতি-লুণ্ঠনের মত জঘন্য অপরাধ সমূহ
নির্বিবাদে করে গেলেও তারা তাদের জনগণের কাছে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হ’তে
রাযী ছিল না। আর তাই এক মিথ্যাকে ঢাকার জন্য শত মিথ্যার আশ্রয় নিতেও তারা
কখনো কুণ্ঠাবোধ করে না।
যাই হোক নির্ধারিত দিনে গযব নাযিল হওয়ার প্রাক্কালেই আল্লাহর হুকুমে হযরত
ছালেহ (আঃ) স্বীয় ঈমানদার সাথীগণকে নিয়ে এলাকা ত্যাগ করেন। যাওয়ার সময় তিনি
স্বীয় কওমকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
يَا قَوْمِ لَقَدْ أَبْلَغْتُكُمْ رِسَالَةَ رَبِّيْ وَنَصَحْتُ لَكُمْ وَلَكِن لاَّ تُحِبُّوْنَ النَّاصِحِيْنَ-
‘হে আমার জাতি! আমি তোমাদের কাছে স্বীয় পালনকর্তার পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি এবং
সর্বদা তোমাদের কল্যাণ কামনা করেছি। কিন্তু তোমরা তোমাদের কল্যাণকামীদের
ভালবাসো না’ (আ‘রাফ ৭/৭৯)।
গযবের ধরন :
হযরত ছালেহ (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী বৃহষ্পতিবার ভোরে অবিশ্বাসী কওমের
সকলের মুখমন্ডল গভীর হলুদ বর্ণ ধারণ করল। কিন্তু তারা ঈমান আনল না বা তওবা
করল না। বরং উল্টা হযরত ছালেহ (আঃ)-এর উপর চটে গেল ও তাঁকে হত্যা করার
জন্য খুঁজতে লাগল। দ্বিতীয় দিন সবার মুখমন্ডল লাল বর্ণ ও তৃতীয় দিন ঘোর
কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গেল। তখন সবই নিরাশ হয়ে গযবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
চতুর্থ দিন রবিবার সকালে সবাই মৃত্যুর জন্য প্রস্ত্ততি নিয়ে সুগন্ধি মেখে
অপেক্ষা করতে থাকে।[6] এমতাবস্থায় ভীষণ ভূমিকম্প শুরু হ’ল এবং উপর থেকে
বিকট ও ভয়াবহ এক গর্জন শোনা গেল। ফলে সবাই যার যার স্থানে একযোগে অধোমুখী
হয়ে ভূতলশায়ী হ’ল (আ‘রাফ ৭/৭৮; হূদ ১১/৬৭-৬৮) এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হ’ল
এমনভাবে, যেন তারা কোনদিন সেখানে ছিল না’। অন্য আয়াতে এসেছে যে, ‘আমরা
তাদের প্রতি একটিমাত্র নিনাদ পাঠিয়েছিলাম। তাতেই তারা শুষ্ক খড়কুটোর মত হয়ে
গেল’ (ক্বামার ৫৪/৩১)।
কোন কোন হাদীছে এসেছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ছামূদ জাতির উপরে আপতিত গযব
থেকে ‘আবু রেগাল’ নামক জনৈক অবিশ্বাসী নেতা ঐ সময় মক্কায় থাকার কারণে বেঁচে
গিয়েছিল। কিন্তু হারাম শরীফ থেকে বেরোবার সাথে সাথে সেও গযবে পতিত হয়।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামকে মক্কার বাইরে আবু রেগালের উক্ত কবরের
চিহ্ন দেখান এবং বলেন যে, তার সাথে একটা স্বর্ণের ছড়িও দাফন হয়ে গিয়েছিল।
তখন কবর খনন করে তারা ছড়িটি উদ্ধার করেন। উক্ত রেওয়ায়াতে একথাও বলা হয়েছে
যে, ত্বায়েফের প্রসিদ্ধ ছাক্বীফ গোত্র উক্ত আবু রেগালের বংশধর। তবে হাদীছটি
যঈফ।[7]
অন্য হাদীছে এসেছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন যে, ‘ছাক্বীফ গোত্রে একজন
মিথ্যাবাদী (ভন্ড নবী) ও একজন রক্ত পিপাসুর জন্ম হবে।[8] রাসূলের এ
ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হয় এবং এই বংশে মিথ্যা নবী মোখতার ছাক্বাফী এবং
রক্তপিপাসু কসাই ইরাকের উমাইয়া গবর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জন্ম হয়। কওমে
ছামূদ-এর অভিশপ্ত বংশের রক্তধারার কু-প্রভাব হওয়াটাও এতে বিচিত্র নয়।
অন্য এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, ৯ম হিজরীতে তাবূক যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) সিরিয়া ও হেজাযের মধ্যবর্তী ‘হিজ্র’ নামক সে স্থানটি অতিক্রম করেন,
যেখানে ছামূদ জাতির উপরে গযব নাযিল হয়েছিল। তিনি ছাহাবায়ে কেরামকে নির্দেশ
দেন, কেউ যেন ঐ গযব বিধ্বস্ত এলাকায় প্রবেশ না করে এবং ওখানকার কূয়ার পানি
ব্যবহার না করে’।[9] এসব আযাব-বিধ্বস্ত এলাকাগুলিকে আল্লাহ তা‘আলা ভবিষ্যৎ
মানবজাতির জন্য শিক্ষাস্থল হিসাবে সংরক্ষিত রেখেছেন, যাতে তারা উপদেশ হাছিল
করতে পারে এবং নিজেদেরকে আল্লাহর অবাধ্যতা হ’তে বিরত রাখে।
আরবরা তাদের ব্যবসায়িক সফরে নিয়মিত সিরিয়া যাতায়াতের পথে এইসব ধ্বংসস্ত্তপ
গুলি প্রত্যক্ষ করত। অথচ তাদের অধিকাংশ তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেনি এবং
শেষনবীর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেনি। যদিও পরবর্তীতে সব এলাকাই ‘মুসলিম’
এলাকায় পরিণত হয়ে গেছে। আল্লাহ বলেন,
وَكَمْ أَهْلَكْنَا مِنْ قَرْيَةٍ بَطِرَتْ مَعِيْشَتَهَا فَتِلْكَ
مَسَاكِنُهُمْ لَمْ تُسْكَن مِّن بَعْدِهِمْ إِلاَّ قَلِيلاً وَكُنَّا
نَحْنُ الْوَارِثِيْنَ، وَمَا كَانَ رَبُّكَ مُهْلِكَ الْقُرَى حَتَّى
يَبْعَثَ فِيْ أُمِّهَا رَسُولاً يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِنَا وَمَا
كُنَّا مُهْلِكِي الْقُرَى إِلاَّ وَأَهْلُهَا ظَالِمُوْنَ- (القصص ৫৮-৫৯)-
‘আমরা অনেক জনপদ ধ্বংস করেছি; যেসবের অধিবাসীরা তাদের বিলাসী জীবন যাপনে
মত্ত ছিল। তাদের এসব আবাসস্থলে তাদের পরে মানুষ খুব সামান্যই বসবাস করেছে।
অবশেষে আমরাই এসবের মালিক রয়েছি’। ‘আপনার পালনকর্তা জনপদ সমূহকে ধ্বংস করেন
না, যে পর্যন্ত না তার কেন্দ্রস্থলে রাসূল প্রেরণ করেন। যিনি তাদের কাছে
আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করেন। আর আমরা জনপদ সমূহকে তখনই ধ্বংস করি, যখন তার
বাসিন্দারা (অর্থাৎ নেতারা) যুলুম করে’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৮-৫৯)।
উল্লেখ্য যে, উপরে বর্ণিত কাহিনীর প্রধান বিষয়গুলি পবিত্র কুরআনের ২২টি
সূরায় ৮৭টি আয়াতে এবং কিছু অংশ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। কিছু অংশ এমনও রয়েছে
যা তাফসীরবিদগণ বিভিন্ন ইস্রাঈলী বর্ণনা থেকে সংগ্রহ করেছেন, যা সত্য ও
মিথ্যা দুই-ই হ’তে পারে। কিন্তু সেগুলি কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় এবং
সেগুলির উপরে ঘটনার প্রমাণ নির্ভরশীল নয়।
কওমে ছামূদ-এর ধ্বংস কাহিনীতে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :
১. সমাজের মুষ্টিমেয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও শক্তিশালী শ্রেণী সবার আগে
শয়তানের পাতানো ফাঁদে পা দেয় ও সমাজকে জাহান্নামের পথে আহবান করে এবং
তাদেরকে ধ্বংসের পথে পরিচালনা করে। যেমন কওমে ছামূদ-এর প্রধান নয় কুচক্রী
নেতা করেছিল (নামল ২৭/৪৮)।
২. দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা সাধারণতঃ অন্যদের আগে আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী হয় ও এজন্য যেকোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্ত্তত হয়ে যায়।
৩. অবিশ্বাসীরা মূলতঃ দুনিয়াবী স্বার্থে আল্লাহ প্রেরিত শরী‘আতে বিশ্বাস ও
তদনুযায়ী আমল প্রত্যাখ্যান করে এবং নিজেদের কল্পিত শিরকী আক্বীদায় বিশ্বাস ও
তদনুযায়ী আমলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এবং তারা সর্বদা তাদের বাপ-দাদা ও
প্রচলিত প্রথার দোহাই দেয়।
৪. নবী ও সংস্কারকগণ সাধারণতঃ উপদেশদাতা হয়ে থাকেন- শাসক নন।
৫. নবী ও সংস্কারকদের বিরুদ্ধে শাসক ও সমাজ নেতাগণ যুলুম করলে সরাসরি আল্লাহর গযব নেমে আসা অবশ্যম্ভাবী।
৬. মানুষকে বিপথে নেওয়ার জন্য শয়তানের সবচাইতে বড় হাতিয়ার হ’ল নারী ও অর্থ-সম্পদ।
৭. হঠকারী ও পদগর্বী নেতারা সাধারণতঃ চাটুকার ও চক্রান্তকারী হয়ে থাকে ও
ঈমানদারগণের বিরুদ্ধে সাময়িকভাবে জয়ী হয়। কিন্তু অবশেষে আল্লাহর কৌশল বিজয়ী
হয় এবং কখনো কখনো তারা দুনিয়াতেই আল্লাহর গযবে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে
যায়। আর আখেরাতের আযাব হয় তার চাইতে কঠিনতর (ক্বলম ৬৮/৩৩)।
৮. আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাকে নে‘মতরাজি দান করেন তাকে পরীক্ষা করার জন্য।
শুকরিয়া আদায় করলে সে আরও বেশী পায়। কিন্তু কুফরী করলে সে ধ্বংস হয় এবং
উক্ত নে‘মত তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
৯. অহংকারীদের অন্তর শক্ত হয়। তারা এলাহী গযব প্রত্যক্ষ করার পরেও তাকে
তাচ্ছিল্য করে। যেমন নয় নেতা ১ম দিন গযবে ধ্বংস হ’লেও অন্যেরা তওবা না করে
তাচ্ছিল্য করেছিল। ফলে অবশেষে ৪র্থ দিন তারা সবাই ধ্বংস হয়ে যায়।
১০. আল্লাহ যালেম জনপদকে ধ্বংস করেন অন্যদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য।
১১. আল্লাহ সংশোধনকামী জনপদকে কখনোই ধ্বংস করেন না।
১২. কখনো মাত্র একজন বা দু’জনের কারণে গোটা সমাজ ধ্বংস হয়ে যায়। ছালেহ
(আঃ)-এর উষ্ট্রী হত্যাকারী ছিল মাত্র দু’জন। অতএব মুষ্টিমেয় কুচক্রীদের
বিরুদ্ধে বৃহত্তর সমাজকে সদা সতর্ক থাকতে হয়।
১৩. কুচক্রীদের কৌশল আল্লাহ ব্যর্থ করে দেন। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না।
যেমন ছামূদ কওমের নেতারা বুঝতে না পেরে অযথা দম্ভ করেছিল (নামল ২৭/৫০-৫১)।
১৪. আল্লাহ মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্যই দুনিয়াতে ছোট-খাট শাস্তির
আস্বাদন করিয়ে থাকেন ও তাদেরকে ভয় দেখান (ইসরা ১৭/৫৯; সাজদাহ ৩২/২১)।
১৫. সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্বে অবশেষে সত্য সেবীদেরই জয় হয়। যেমন হযরত ছালেহ
(আঃ) ও তাঁর ঈমানদার দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা এলাহী গযব থেকে নাজাত পেয়ে
বিজয়ী হয়েছিলেন ও মিথ্যার পূজারী শক্তিশালীরা ধ্বংস হয়েছিল।
[1]. তারীখুল আম্বিয়া ১/৪৯ পৃঃ।
[2]. বুখারী হা/৪৩৩; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫১২৫ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায় ‘যুলুম’ অনুচ্ছেদ।
[3]. যথাক্রমে: (১) সূরা আ‘রাফ ৭/৭৩-৭৯ (২) তওবা ৯/৭০ (৩) হূদ ১১/৬১-৬৮, ৮৯ (৪) ইবরাহীম ১৪/৯ (৫) হিজর ১৫/৮০-৮৪ (৬) ইসরা ১৭/৫৯ (৭) হজ্জ ২২/৪২ (৮) ফুরক্বান ২৫/৩৮-৩৯ (৯) শো‘আরা ২৬/১৪১-১৫৯ (১০) নামল ২৭/৪৫-৫৩ (১১) আনকাবূত ২৯/৩৮ (১২) ছোয়াদ ৩৮/১৩ (১৩) গাফের/মুমিন ৪০/৩১-৩৩ (১৪) ফুছছিলাত/হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৩, ১৭-১৮ (১৫) ক্বাফ ৫০/১২ (১৬) যারিয়াত ৫১/৪৩-৪৫ (১৭) নাজম ৫৩/৫১ (১৮) ক্বামার ৫৪/২৩-৩১ (১৯) আল-হা-ক্বক্বাহ ৬৯/৪-৫ (২০) বুরূজ ৮৫/১৮ (২১) ফাজ্র ৮৯/৯ (২২) শাম্স ৯১/১১-১৫। সর্বমোট ৮৭।
[4]. মুসলিম, হা/২৮৫৫; কুরতুবী হা/৩১০৬; আ‘রাফ ৭৭-৭৯; ইবনু কাছীর, ঐ।
[5]. তাফসীর ইবনু কাছীর, সূরা আ‘রাফ ৭৭-৭৮।
[6]. ইবনু কাছীর, সূরা আ‘রাফ ৭৩-৭৮।
[7]. ইবনু কাছীর, আ‘রাফ ৭৮; আলবানী, যঈফ আবুদাঊদ, ‘কবর উৎপাটন’ অনুচ্ছেদ; যঈফাহ হা/৪৭৩৬।
[8]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫৯৯৪ ‘কুরায়েশ-এর মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ।
[9]. বুখারী হা/৪৩৩, মুসলিম, আহমাদ, ইবনু কাছীর, সূরা আ‘রাফ ৭৩
[2]. বুখারী হা/৪৩৩; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫১২৫ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায় ‘যুলুম’ অনুচ্ছেদ।
[3]. যথাক্রমে: (১) সূরা আ‘রাফ ৭/৭৩-৭৯ (২) তওবা ৯/৭০ (৩) হূদ ১১/৬১-৬৮, ৮৯ (৪) ইবরাহীম ১৪/৯ (৫) হিজর ১৫/৮০-৮৪ (৬) ইসরা ১৭/৫৯ (৭) হজ্জ ২২/৪২ (৮) ফুরক্বান ২৫/৩৮-৩৯ (৯) শো‘আরা ২৬/১৪১-১৫৯ (১০) নামল ২৭/৪৫-৫৩ (১১) আনকাবূত ২৯/৩৮ (১২) ছোয়াদ ৩৮/১৩ (১৩) গাফের/মুমিন ৪০/৩১-৩৩ (১৪) ফুছছিলাত/হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৩, ১৭-১৮ (১৫) ক্বাফ ৫০/১২ (১৬) যারিয়াত ৫১/৪৩-৪৫ (১৭) নাজম ৫৩/৫১ (১৮) ক্বামার ৫৪/২৩-৩১ (১৯) আল-হা-ক্বক্বাহ ৬৯/৪-৫ (২০) বুরূজ ৮৫/১৮ (২১) ফাজ্র ৮৯/৯ (২২) শাম্স ৯১/১১-১৫। সর্বমোট ৮৭।
[4]. মুসলিম, হা/২৮৫৫; কুরতুবী হা/৩১০৬; আ‘রাফ ৭৭-৭৯; ইবনু কাছীর, ঐ।
[5]. তাফসীর ইবনু কাছীর, সূরা আ‘রাফ ৭৭-৭৮।
[6]. ইবনু কাছীর, সূরা আ‘রাফ ৭৩-৭৮।
[7]. ইবনু কাছীর, আ‘রাফ ৭৮; আলবানী, যঈফ আবুদাঊদ, ‘কবর উৎপাটন’ অনুচ্ছেদ; যঈফাহ হা/৪৭৩৬।
[8]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫৯৯৪ ‘কুরায়েশ-এর মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ।
[9]. বুখারী হা/৪৩৩, মুসলিম, আহমাদ, ইবনু কাছীর, সূরা আ‘রাফ ৭৩
সালেহ (আঃ) এর জীবনি |
0 Comments