যুবক, যিনা, যৌনতা ও কিছু অপ্রিয় কথা

সময়ের পরিক্রমায় মানুষ একটা সময় যৌবনে পদার্পণ করে। তবে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণটা শুধু যৌবনেই সৃষ্টি হয় না। বরং এর কিছুকাল পূর্বেই শুরু হয়, আবার শেষ হয় অনেকটা পরেই। আর এ মধ্যবর্তী সময়টাই কারো জন্য সম্পদ কিংবা অস্ত্রে পরিণত হয়, যা তার পরবর্তী অবস্থান নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
প্রায় সময়ই দেখি অবসরে কিংবা ক্লাসের ফাঁকে দু-তিনজন যুবক একসাথে হতেই এদের আলোচনার মূল টপিক হয়ে উঠে একটি মেয়ে। আর তা কতোটা নোংরা ভাষায় হয়ে থাকে তা কেউ একবার শুনলেই বুঝতে পারবেন। আবার ক্লাসের ম্যাডাম একটু ফর্সা হলেই, রাস্তায় হঠাৎ চোখে পড়া মেয়েটি স্টাইলিশ হলেই, খেলা দেখতে আসা অর্ধ-উলঙ্গ মেয়েটির উপর ক্যামেরা ধরতেই তারা তাৎক্ষণিকভাবে চরিত্রহারা হয়ে উঠে। এমনকি মাঝারি বয়সের লোকগুলো যখন চায়ের দোকানে টিভি পর্দার সামনে বসে আড্ডা দেয় তখনও আলোচনার বিষয় একটি নারীর বিভিন্ন দিক। কী অদ্ভুত আচরণ! অথচ তারা তাদের মা-বোন, স্ত্রী-মেয়ের সাথে একই ছাদের নিচে বসবাস করে আসছে বহুদিন হতে। তাহলে কীভাবে গড়ে উঠলো এ অসভ্যতা? কোথায় এর প্রতিকার?
তাই একজন মুসলিম যুবক হিসেবে এ বিষয়ে এখানে কিছু লেখার চেষ্টা করছি। তবে এ লেখার বেশিরভাগ অংশই পূর্বে (প্রায় সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগেই) প্রকাশিত হয়ে গেছে, কিন্তু অনেকেরই অজানা কিংবা অবহেলায় তা আজ হারিয়ে যাচ্ছে। আর এ অজানা কিংবা অবহেলিত বিষয়গুলোর দু-একটার উপর ভিত্তি করেই এ লিখা। যা অনেকের মাঝে গড়ে ওঠা কিছু নোংরা বিষয়কে বিসর্জন দিতে সহায়তা করবে। (ইনশা আল্লাহ)
যুবকদের মধ্যে গড়ে ওঠা এই অসভ্যতার পেছনে মূল কারণ হলো আল্লাহভীতি ও ইসলামী জ্ঞানের অভাব৷ কেউ যখন অন্যায়কে অন্যায় মনে করবে না তখন সে মন যা চায় তাই করতে পারবে৷ আর লজ্জাহীনতা যখন কারো নিকট সাহসে রূপ নেয় তখন সে যিনা-ব্যাভিচার বলে কিছুই বিশ্বাস করবে না৷
অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “দুই চক্ষুর যিনা হচ্ছে- দেখা, দুই কানের যিনা হচ্ছে- শুনা, জিহ্বার যিনা হচ্ছে- কথা, হাতের যিনা হচ্ছে- ধরা, পায়ের যিনা হচ্ছে- হাঁটা, অন্তর কামনা-বাসনা করে; আর যৌনাঙ্গ সেটাকে বাস্তবায়ন করে অথবা করে না।” [সহীহ মুসলিম: ২৬৫৭]
আর তেমনি এক যুবক কোনো এক মজলিসে এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললো, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমাকে যিনা করার অনুমতি দিন।’ এ কথা শুনে উপস্থিত সবাই চমকে উঠলেন এবং তাকে তিরস্কার করতে লাগলেন। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (আদরের সহিত) ‘আমার কাছে এসো।’ সে কাছে এলো । বললেন, ‘বসো।’ সে বসলো। এরপর (তার ঊরুতে হাত রেখে) বললেন, ‘তুমি কি তোমার মায়ের জন্য এটা পছন্দ করবে?’
 সে বললো, ‘না ইয়া রাসূলুল্লাহ। আল্লাহ আমাকে আপনার প্রতি উৎসর্গিত করুন। কোনো মানুষই তার মায়ের জন্য এটা পছন্দ করবে না।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তাহলে তোমার মেয়ের জন্য?’ যুবকটি বললো, ‘না, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি আপনার প্রতি উৎসর্গিত। কোনো মানুষই তার মেয়ের জন্য এটা পছন্দ করবে না।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তাহলে তোমার বোনের জন্য?’ যুবক বললো, ‘না ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি আপনার প্রতি উৎসর্গিত। কোনো মানুষই তার বোনের জন্য এটা পছন্দ করবে না।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তাহলে তোমার ফুফুর জন্য?’ যুবক বললো,‘না ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি আপনার প্রতি উৎসর্গিত। কোনো মানুষই তার ফুফুর জন্য এটা পছন্দ করবে না।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তাহলে তোমার খালার জন্য?’ যুবক বললো, ‘না, কক্ষনো না। আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গিত করুন। কোনো মানুষই তার খালার জন্য এটা পছন্দ করবে না।’
এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার শরীরে হাত রাখলেন এবং দুআ করলেন- ‘ইয়া আল্লাহ তার গুনাহ ক্ষমা করুন, তার অন্তর পবিত্র করুন এবং তার চরিত্র রক্ষা করুন।’ বর্ণনাকারী বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষার ফলাফল এই হল যে, পরবর্তী জীবনে সে (রাস্তায় চললে) কোন দিকে চোখ তুলেও তাকাতো না। [মুসনাদে আহমদ: ৫/২৫৬-২৫৭]
আর এরূপ যুবকদের পুরস্কার স্বরূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি আমাকে তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী জিনিস (জিহ্বার) এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী জিনিসের (যৌনাঙ্গের) নিশ্চয়তা দেবে (সঠিক ব্যবহার করবে) আমি তার জান্নাতের নিশ্চয়তা দিবো৷” [বুখারী: ৬৪৭৪]
একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহুমদের উদ্দেশ্যে বলেন, “তোমরা (বেগানা) নারীদের নিকট (একাকী) যাওয়া থেকে বিরত থাকো।” এ কথা শুনে জনৈক আনসারী নিবেদন করলেন, ‘স্বামীর আত্মীয় সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?’ তিনি বললেন, “স্বামীর আত্মীয় তো মৃত্যুসম (বিপজ্জনক) ।” [বুখারী, মুসলিম, রিয়াযুস স্বা-লিহীন: ১৬৩৬]
উপরে বর্ণিত হাদীসগুলোর প্রতিটা লাইনই যেন আমাদের মতো যুবকদের চোখ খুলে দেয়, আর স্পষ্ট করে দেয় আমাদের প্রতিটা ভুল পদক্ষেপ৷ তবে এই মন্দ আচরণগুলোকে আকর্ষণীয় করে তুলতে শয়তান তার সর্বোচ্চ চেষ্টা সবসময়ই চালিয়ে যাচ্ছে৷ যা কখনো ভবিষ্যত পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে চরিত্র বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হয়৷ তাই এ পথচলা থেকে ঘুরে দাড়ানোই আমাদের একমাত্র মুক্তির উপায়৷ তবে তা তখনই সহজ হবে যখন আমাদের বোনগুলো নিজেদেরকে ইসলাম দিয়ে ঢেকে নিবে এবং বান্ধবী হয়ে কারো দ্বীনকে নষ্ট না করে স্ত্রী হয়ে কারো দ্বীনের অর্ধেক পূরণ করবে৷ আল্লাহ্ আমাদের বোনদের জন্য সহজ করুন৷
শাইখ ইবনে জিবরিনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো- কোনো যুবক-যুবতীদের যোগাযোগের ব্যাপারে ইসলাম কী বলে, যদিও তারা অনৈতিক কার্যকলাপ ও পরস্পর ভালোবাসা থেকে দূরে থাকে। তিনি বলেন:
কোনো মেয়ের সাথে কোনো ছেলের যোগাযোগ রাখা বৈধ নয় যদি না সে তার মাহরাম
হয়। তারা মনে করতে পারে, এতে কোন ফিতনার সম্ভাবনা নেই; কিন্তু শয়তান এই বিষয়ে সবসময়ই তৎপর। সে সুযোগ পেলেই তাদের অন্তরে (অবৈধ) ভালোবাসা ও অনৈতিক কর্মের সূচনা করে দিবে। [ফাতাওয়া আল মার’আহ, পৃ: ৯৬]
পরিশেষে আমাদের প্রতি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি উপদেশ দিয়ে শেষ করছি –
‘হে যুব সম্প্রদায়, তোমাদের মধ্যে যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিয়ে করে। কেননা তা চক্ষুকে অবনত করে এবং লজ্জাস্থানকে হেফাযত করে। আর যে এর সামর্থ্য রাখে না, তার কর্তব্য রোযা রাখা। কেননা তা যৌন উত্তেজনার প্রশমন ঘটায়।’ [বুখারী: ১৯০৫; মুসলিম: ১৪০০]

Post a Comment

0 Comments