বিদেশীদেরকে হত্যার ব্যাপারে ফতোয়া
প্রশ্ন:
সম্মানিত শাইখ, বিভিন্ন মুসলিম দেশে বিদেশীদেরকে হত্যার উদ্দেশ্যে যে সকল
আক্রমণ পরিচালিত হচ্ছে- সেখানে কিছু মুসলিমও নিহত হচ্ছে, বিভিন্ন ভবন ও
প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হচ্ছে আর যারা এগুলো করছে তারা এটিকে জিহাদ বলছে! এ
সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
উত্তর: আল হামদু লিল্লাহ-সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর।
♦ প্রথমত:
বিভিন্ন
মুসলিম দেশে বিদেশীদেরকে হত্যার উদ্দেশ্যে যে সকল আক্রমণ পরিচালতি হচ্ছে
এবং সেখানে কিছু মুসলিমও নিহত হচ্ছে-যেমনটি আপনি উল্লেখ করেছন- তা জিহাদ
নয়। বরং তা সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলা, ধ্বংসাত্মক এবং কুৎসিত কর্ম। এ কাজ
মূর্খতা ও জ্ঞানকাণ্ড হীনতার পরিচায়ক। কেননা, এ সকল বিদেশীরা মুসলিম দেশে
নিরাপত্তা প্রাপ্ত। তারা অনুমতি ছাড়া এ দেশে প্রবেশ করে নি। সুতরাং হত্যা
তো দূরে থাক প্রহার, সম্পদ লুণ্ঠন সহ তাদের প্রতি কোন ধরণের অন্যায় আচরণ
করার সুযোগ নাই। তাদের জান-মাল সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে।
যে
ব্যক্তি তাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে সে মারাত্মক ধ্বংসাত্মক পরিণতির
সম্মুখীন হবে। যেমনটি সহীহুল বুখারীতে প্রখ্যাত সাহাবী আমল ইবনুল আস রা.
হতে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَنْ قَتَلَ مُعَاهَدًا لَمْ يَرَحْ رَائِحَةَ الْجَنَّةِ وَإِنَّ رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ أَرْبَعِينَ عَامًا
“যে
ব্যক্তি মুআহিদ তথা চুক্তিবদ্ধ ভাবে মুসলিম দেশে বসবাসকারী অমুসলিমকে
হত্যা করবে সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না (জান্নাতে যাওয়া তো দূরে থাক)
অথচ চল্লিশ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেজান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।” (সহীহুল বুখারী হা/৩১৬৬)
এই বিধান যিম্মী, মুআহিদ এবং মুস্তামিন সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। [1]
হাফেজ
ইবনে হাজার আসকালানী রহ. ফাতহুল বারীতে বলেন, মুআহিদ বলতে এমন কাফিরকে
বুঝায় যার সাথে মুসলিমদের সাথে চুক্তি আছে। চাই জিযিয়া (অমুসলিমদের উপর
ইসলামী সরকারের পক্ষ থেকে অর্পিত কর) প্রদানের মাধ্যমে হোক কিংবা সরকারের
সাথে যুদ্ধ বিরতির চুক্তির মাধ্যমে হোক বা সাধারণ কোন মুসলিমের পক্ষ থেকে
নিরাপত্তা প্রদানের মাধ্যমে হোক।
“সাধারণ
কোন মুসলিমের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা প্রদানের মাধ্যমে হোক।” এ কথার মাধ্যমে
ইমাম ইবনে হাজার রহ. ফকিহদের নিকট সুপরিচিত একটি মূলনীতির দিকে ইঙ্গিত
করেছেন। আর তা হল, “কেবল শাসক বা সুলতানের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা দেয়া শর্ত
নয় বরং যে কোন সাধারণ মুসলিমের পক্ষ থেকেও নিরাপত্তা দেয়া জায়েজ রয়েছে।”
এই
বিদেশীরা মুসলিম দেশে প্রবেশ করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কিংবা কোন মুসলিমের
নিরাপত্তার মাধ্যমে। সুতরাং তাদের ক্ষতি সাধন করা কারও জন্য বৈধ নয় যদিও
তারা মুহারিবীন তথা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধরত কাফির হয়।
ইমাম
বুখারী (হা/৩১৭১) ও মুসলিম (হা/৩৩৬) রহ. উম্মে হানী বিনতে আবী তালিব রা.
থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট গেলাম। গিয়ে দেখলাম, তিনি গোসল করছেন আর তাঁর
মেয়ে ফাতিমা রা. তাঁকে পর্দা দিয়ে ঘিরে রেখেছেন।
তারপর আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সালাম দিলে তিনি (সালামের উত্তর প্রদাণের পর) জিজ্ঞেস করলেন: কে আপনি?
আমি বললাম: উম্মে হানী বিনতে আবী তালিব।
তিনি বললেন: উম্মে হানী, আপনাকে স্বাগতম।
অত:পর তিনি গোসল শেষ করে একটি মাত্র কাপড়ে শরীরে পেঁচিয়ে আট রাকআত নামায আদায় করলেন।
অত:পর
আমি তাঁকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমার মায়ের বেটা (অর্থাৎ আমার ভাই)
আলী বলছে, সে হুবায়রার উমুক ছেলের সাথে লড়াই করবে অথচ আমি তাকে আশ্রয়
দিয়েছি।
তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন:
قَدْ أَجَرْنَا مَنْ أَجَرْتِ يَا أُمَّ هَانِئٍ
“হে উম্মে হানী, আপনি যাকে আশ্রয় দিয়েছেন আমরাও তাকে আশ্রয় দিলাম।”
উম্মে হানী রা. বলেন, তখন ছিল অপরাহ্ণ।
ইবনে কুদামা রহ. বলেন, “আমাদের মধ্য থেকে যে কোন পুরুষ, নারী অথবা দাস কাফেরদেরকে নিরাপত্তা দিলে তা প্রযোজ্য হবে।”
মোটকথা,
কোন যুদ্ধরত কাফিরকেও যদি নিরাপত্তা দেয়া হয় তবে তাকে হত্যা করা, তার
সম্পদ হরণ করা বা তার কোন ধরণের ক্ষতি সাধন করা হারাম। প্রাপ্ত বয়স্ক ও
সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন যে কোন মুসলিম স্বেচ্ছায় এই নিরাপত্তা প্রদান করলে
তা গ্রহণযোগ্য হবে- চাই সে পুরুষ হোক বা নারী হোক, স্বাধীন হোক বা দাস হোক।
ইমাম সুফিয়ান সাওরী, ইমাম আওযায়ী, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম ইসহাক, ইমাম ইবনুল কাসেম সহ অধিকাংশ বিদ্বানের এটাই অভিমত। (আল মুগনী ৯/১৯৫)
♦ দ্বিতীয়:
কোন
মুস্তামিন (সাময়িকভাবে নিরাপত্তা প্রাপ্ত অমুসলিম) অথবা মুআহিদ (যুদ্ধ
বিরতিতে চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম) যদি চুক্তি ভঙ্গ করে তবে কোন সাধারণ মুসলিমের
জন্য বৈধ নয়, তাকে হত্যা করা। কারণ, এতে নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।
রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে
উবাই ইবনে সুলুলকে হত্যা করা থেকে বিরত থেকেছেন এই ভয়ে যে, কাফিররা বলাবলি
করবে, মুহাম্মদ তার সঙ্গী-সাথীদেরকে হত্যা করছে!!
তদ্রূপ
কেউ যদি মুরতাদ তথা ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় বা কেউ যদি মৃত্যুদণ্ড যোগ্য
অপরাধ করে তবে সাধারণ কোন মুসলিমের জন্য তাকে হত্যা করা বৈধ নয়। (অর্থাৎ
কোন সাধারণ মুসলিমের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগের অধিকার নেই। এটি সম্পূর্ণ
মুসলিম সরকার ও আদালতের বিষয়)।
কেননা,
এ ধরণের হত্যাকাণ্ড মুসলিমদের জন্য বিরাট সমস্যা ও বিপদ ডেকে নিয়ে আসে।
দাওয়াতি কাজকে বাধাগ্রস্ত করে এবং দাঈদেরকে মারাত্মক চাপের মধ্যে ফেলে দেয়।
সেই সাথে সুযোগ সন্ধানী স্বার্থান্বেষী মহল এ সব কর্মকাণ্ডকে ইসলাম ও
মুসলিমদের বদনাম করার কাজে ব্যবহার করে।
♦ তৃতীয়:
নিরপরাধ মুসলিমদেরকে হত্যা করা একটি মারাত্মক অপরাধ এবং বিরাট গুনাহের কাজ। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
زَوَالُ الدُّنْيَا أَهْوَنُ عَلَى اللَّهِ مِنْ قَتْلِ رَجُلٍ مُسْلِمٍ
“একজন (নিরপরাধ) মুসলিম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার চেয়ে আল্লাহর নিকট সারা পৃথিবী ধ্বংস হওয়া সহজ বিষয়।” (তিরমিযী, হাদীস নং ১২৯৫, নাসাঈ, হাদীস নং ৩৯৮৭ ও ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ২৬১৯ –আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত)
সুতরাং
এদের কার্যক্রম অন্ধকারাচ্ছন্ন। এর মূল কারণ হল, ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা,
অসহিষ্ণুতা এবং বিজ্ঞ আলেমদের শরণাপন্ন না হওয়া। অথচ আল্লাহ তায়ালা
আমাদেরকে যে কোন সমস্যা ও সংকটে বিজ্ঞ আলেমদেরকে জিজ্ঞেস করার বা তাদের
শরণাপন্ন হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
বড়
বড় নির্ভরযোগ্য আলেমগণ এ সকল কার্যক্রমকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে সর্তক
করেছেন। কারণ, একদিকে এগুলো মূলতই এগুলো হারাম কাজ। অন্য দিকে এসব অপকর্মের
ফলে দেশে বিরাট বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং মুসলিমদের উপর নেমে আসে নানা
সমস্যা।
সুতরাং
সকলের জন্য অবশ্য কর্তব্য হল, মহান আল্লাহকে ভয় করা আর মুসলিমের দেয়া
নিরাপত্তা লঙ্ঘন, অন্যায় রক্তপাত এবং মুসলিমদের উপর বিপদ-বিশৃঙ্খলা টেনে
আনার ব্যাপারে কঠিন সতর্কতা অবলম্বন করা।
আল্লাহ সকলকে তাঁর পছন্দনীয় ও সন্তোষ জনক কাজ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
আল্লাহ সবচেয়ে ভাল জানেন।
♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥
বিদেশীদেরকে হত্যার ব্যাপারে ফতোয়া (ফতোয়া নং ১৩২৫২০)
উৎস: শাইখ সালিহ আল মুনাজ্জিদ কৃর্তক পরিচালিত islamqa.info
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব
টিকা:
[1] ক.
যিম্মী: (কর প্রদানের শর্তে মুসলিম দেশে বসবাসকারী অমুসলিম) অর্থাৎ এমন
অমুসলিম যার সাথে এ মর্মে চুক্তি রয়েছে যে, মুসলিম দেশে নিরাপত্তার সাথে
বসবাস করবে কিন্তু এর বিনিময়ে সে মুসলিম সরকারকে যিযিয়া (কর) প্রদান করবে।
খ.
মুআহিদ: (যুদ্ধ বিরতির শর্তে মুসলিম দেশে বসবাসকারী অমুসলিম) অর্থাৎ এমন
অমুসলিম যার সাথে এ মর্মে চুক্তি রয়েছে যে, সে মুসলিম দেশে বসবার করবে
কিন্তু মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না; মুসলিমগণও তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ
করবে না।
গ.
মুস্তামিন: (সাময়িকভাবে নিরাপত্তার লাভ করে মুসলিম দেশে বসবাসকারী
অমুসলিম) অর্থাৎ এমন অমুসলিম যার সাথে কর প্রদান বা যুদ্ধ বিরতির চুক্তি
নেই কিন্তু সে বিশেষ প্রয়োজনে মুসলিম দেশে প্রবেশ করেছে। যেমন,
ব্যবসা,চিকিৎসা,কূটনৈতিক সম্পর্ক কিংবা ইসলাম সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্যে
ইত্যাদি।
(আল্লামা মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উসাইমীন কর্তৃক প্রদত্ব সঙ্গা অনুসারে)
উক্ত
তিন শ্রেণীর অমুসলিমকে হত্যা করা, তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করা কিংবা কোন ধরণের
ক্ষতি সাধানের চেষ্টা করা ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। -অনুবাদক
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
সূত্র: সালাফী বিডি
0 Comments