প্রশ্নোত্তরে তাওহীদ (১ম পর্ব)


প্রশ্নোত্তরে তাওহীদ (১ম পর্ব)
بسم الله الرحمن الرحيم
পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে
ভুমিকা
সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য। শ্রেষ্ঠ রাসূল আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবারবর্গ এবং সমস্ত সাহাবীদের উপর সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক...অতঃপর,
তাওহীদ বিষয়ক এ প্রশ্নোত্তরসমূহ চয়ন করেছি মহান আল্লাহর কালাম ও তাঁর রসূলের বাণী অতঃপর উত্তম জাতীর বিশিষ্ট আলেমগণের আলোচিত মাসয়ালা-মাসায়েল থেকে। আর আমাদের এ পুস্তিকা সংকলনের সম্মানজনক সূযোগ করে দিয়েছে রিয়াদ  মহানগরীর শাফা এলাকার ‘দাওয়াত ও নির্দেশনা সহযোগী অফিসে’র জ্ঞান-গবেষণা বিভাগ। উদ্দেশ্য হচ্ছে পুস্তিকা প্রণয়ন করে মহামর্যাদাবান আল্লাহর দীন গ্রহণকারীদের জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করা এবং তা থেকে অন্যান্য মুসলিমদের ব্যাপাক ফায়দা অর্জন। এ পুস্তিকার নাম দেয়া’’ (التوحيد بين السائل والمجيب) [বা প্রশ্নোত্তরে তাওহীদ]।
আমি যেহেতু জ্ঞান-গবেষণা বিভাগের সদস্য, সেহেতু এ পুস্তকটি প্রণয়ন করেছি শিক্ষাদানের সিলেবাস হিসেবে।

মহা-বরকতময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদের নেক প্রচেষ্টা কবুল করেন এবং উত্তম পুরষ্কার প্রদান করেন। আর ক্বিয়ামত দিবসে নেক আমলের পাল্লা ভারী করে দেন। আমাকে, আমার মাতা-পিতাকে  এবং সকল মুমিনদেরকে বিচার দিবসে মাফ করে দেন। যারা মহা-মহিয়ান আল্লাহর দিকে ডাকে, সাহায্য করে, সৎকাজের আদেশ দান করে, সেদিকে দাওয়াত দেয়, আর যারা পাপকাজ করেন অপছন্দ ও তা থেকে নিষেধ করে তাদের প্রচেষ্টাকে আল্লাহ যেন বরকতময় করে দেন। আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবারবর্গ এবং সাহাবীগণের উপর সন্তুষ্টি ও শান্তি বর্ষণ করুন।

লিপিবদ্ধ হয়েছে যার কলমে তিনি আল্লাহর ক্ষমার ভিখারী;
ড. ইব্রাহীম ইবন সালেহ আল-খুদ্বায়রী
বিচারপতি উচ্চতর আদালত, রিয়াদ,
রাজকীয় সৌদী আরব।
(আল্লাহ তাঁকে এবং তাঁর মাতা-পিতাকে
ও মুমিনদেরকে মাফ করে দিন।)
১৫/০৪/১৪২১ হিজরী।



পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে

{প্রশ্ন:১} সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী আল্লাহ আমাদেরকে কেন সৃষ্টি করেছেন এবং তার দলীল কী?
উত্তর: আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদাত বন্দেগী করার জন্যেই আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। দলীল হলো, আল্লাহর বাণী,
﴿ وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ ﴾ [الذاريات: ٥٦] 
‘‘আর আমি জ্বিন এবং মানুষকে এ জন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমারই ‘‘ইবাদাত’ করবে’’। (সূরা আয-যারিয়াত: ৫৬)
উল্লেখ্য যে, ইবাদাতের অর্থ হলো: আদেশ, নিষেধ, সৃষ্টি ও ইবাদাতে আল্লাহকে একক জানতে হবে।

{প্রশ্ন:২} ইসলামী শরীয়ত বলতে কি বুঝায় এবং এর বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী?
উত্তর: ইসলামী শরীয়ত হলো একটি সুনির্দিষ্ট পথ ও পদ্ধতি; যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একমাত্র জীবন বিধান হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ইসলামী শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:
(ক) এটা আল্লাহর নিকট থেকে এসেছে; আল্লাহ বলেন:
﴿ ثُمَّ جَعَلۡنَٰكَ عَلَىٰ شَرِيعَةٖ مِّنَ ٱلۡأَمۡرِ فَٱتَّبِعۡهَا وَلَا تَتَّبِعۡ أَهۡوَآءَ ٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَ ١٨ ﴾ [الجاثية: ١٨] 
‘‘অতঃপর আমরা আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি নির্ধারিত শরীয়তের বিধানের উপর; সুতরাং আপনি এর অনুসরণ করুন, আর তাদের ইচ্ছা ও বাসনার অনুসরণ করবেন না, যাদের ইলম-জ্ঞান নেই’’[1]।
আল্লাহ আরো বলেন:
﴿ وَٱللَّهُ بَصِيرُۢ بِٱلۡعِبَادِ ﴾ [ال عمران: ١٥] 
‘‘আর আল্লাহ বান্দাদের প্রতি সম্যক দ্রষ্টা’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৫) 
অর্থাৎ মহান আল্লাহ বান্দাদের প্রতি সবিশেষ দৃষ্টি রাখেন এবং তিনি বান্দাদের কল্যাণের ব্যাপারে সর্বাধিক অবহিত।
(খ) এটা একমাত্র পূর্ণাঙ্গ, সর্বাত্মক, সার্বজনীন, শাশ্বত জীবন বিধান; মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗاۚ ﴾ [المائ‍دة: ٣] 
‘‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে (জীবন বিধান) পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ (নেয়ামত) সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন (জীবন বিধান) নির্ধারণ করলাম’’[2]।
অনুরূপভাবে সূরা মরিয়মের ৬৪ নং আয়াতে আছে:
﴿ ۚ وَمَا كَانَ رَبُّكَ نَسِيّٗا ﴾ [مريم: ٦٤] 
‘‘আর আপনার রব কখনই ভুলে যান না’’।
ইসলামী শরীয়ত নামক বিধান আল্লাহর মনোনিত জীবন বিধান। মানুষের যাবতীয় প্রয়োজনের সুষ্ঠু সমাধান, দুনিয়া ও আখেরাতের সুখ-শান্তি নিহিত আছে আল্লাহ প্রদত্ত এ বিধানের মধ্যেই।
(গ) এটি সর্বকালীন এবং সর্বস্থানের উপযোগী একমাত্র আদর্শ বিধান। প্রতিদিন সূর্য উদিত হয় এবং আমরা দেখতে পাই যে, পৃথিবী শরীয়তের আলো হতে যা প্রয়োজন তা গ্রহণ করেছে। সুস্থ বুদ্ধি বিবেক এ সুন্দরতম সুশৃংখল নিয়ম-পদ্ধতি দেখে এ বিধানের প্রতি আগ্রহ উৎসাহ অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে এবং সাক্ষ্য দিবে যে, এ বিধানই নির্ভরযোগ্য একমাত্র অনুসরণীয় আদর্শ বিধান। এটা শান্তিময় আলোর পথ এবং ঈমানদারদের জন্য এটা আল্লাহর নেয়ামতসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম নেয়ামত। সুমহান আল্লাহ বলেন:
﴿ لَقَدۡ مَنَّ ٱللَّهُ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ إِذۡ بَعَثَ فِيهِمۡ رَسُولٗا مِّنۡ أَنفُسِهِمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبۡلُ لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٍ ١٦٤ ﴾ [ال عمران: ١٦٤] 
‘‘তাদের নিজেদের (মানুষের) মধ্য থেকেই তাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করে আল্লাহ মু’মিনদের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন; সে তাঁর (আল্লাহর) আয়াত তাদের নিকট তেলাওয়াত করে, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং কিতাব ও হিকমাত (যাবতীয় বিষয়বস্তুকে সঠিক জ্ঞান দ্বারা জানাকে হিকমত বলে) শিক্ষা দেয়, যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিল’’। (সূরা আল ইমরান: ১৬৪)
(ঘ) এটা নিরাপত্তার নিশ্চিত ব্যবস্থা। অতএব ইসলাম সম্পর্কে যে যত বেশী জ্ঞান অর্জন করবে তত বেশী সে ইসলামী শরীয়তের শ্রেষ্ঠত্বে মহাত্ম্যে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হবে। অতঃপর এ বিধানকে সে নিজে আঁকড়ে ধরে তা প্রচারের চেষ্টা করবে। আর যে সর্বোত্তম  নেয়ামতকে (ইসলাম) গ্রহণ ও শক্তভাবে ধারণ করতে পারবে সে ব্যক্তিই মানুষের মাঝে স্থিতাবস্থায় মানসিক শান্তি ও নিরাপত্তা অনুভব করবে। ব্যক্তিগত স্বস্তি ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন:
﴿أَلَا بِذِكۡرِ ٱللَّهِ تَطۡمَئِنُّ ٱلۡقُلُوبُ ﴾ [الرعد: ٢٨] 
‘‘আল্লাহর যিকিরে কি তোমাদের চিত্ত প্রশান্ত হয় না’’। (সূরা আর-রা‘দ-২৮)
অনুরূপভাবে সামজিক ও পারিপার্শ্বিক শান্তি-নিরাপত্তার ব্যবস্থা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:
﴿ وَلَكُمۡ فِي ٱلۡقِصَاصِ حَيَوٰةٞ يَٰٓأُوْلِي ٱلۡأَلۡبَٰبِ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٧٩ ﴾ [البقرة: ١٧٩] 
‘‘হে বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ! কিসাসের মধ্যেই তোমাদের জীবন রয়েছে। আশা করা যায় যে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে’’। (সূরা আল-বাকারাহ: ১৭৯)
তদ্রূপ আখেরাতে বা পরকালে জাহান্নামের আগুন থেকে নিরাপদ ও মুক্ত থাকার নিশ্চয়তা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন:
﴿ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَلَمۡ يَلۡبِسُوٓاْ إِيمَٰنَهُم بِظُلۡمٍ أُوْلَٰٓئِكَ لَهُمُ ٱلۡأَمۡنُ وَهُم مُّهۡتَدُونَ ٨٢ ﴾ [الانعام: ٨٢] 
‘‘যারা ঈমান এনেছে অতঃপর তাদের ঈমানকে যুলুম (শির্ক) দ্বারা কুলুষিত করেনি, তাদের জন্যই নিরাপত্তা এবং এরাই হেদায়াতপ্রাপ্ত ও সত্যনিষ্ঠ। (সূরা আল-আন‘আম: ৮২)
(ঙ) এটা দুনিয়া ও আখেরাতে স্থায়ী সুখ-শান্তির ব্যাবস্থা। প্রত্যেকেই সুখ-শান্তি কামনা করে এবং সুখ কোথায় আছে তা খুজে বেড়ায়। আর কেউই সুখ-শান্তির বিপরীত চিন্তা করে না। স্থায়ী সুখ-শান্তি প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেনঃ
﴿ ۞وَأَمَّا ٱلَّذِينَ سُعِدُواْ فَفِي ٱلۡجَنَّةِ خَٰلِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ ٱلسَّمَٰوَٰتُ وَٱلۡأَرۡضُ ﴾ [هود: ١٠٨] 
‘‘আর যারা ভাগ্যবান তাদের স্থান জান্নাতে, সেখানেই তারা স্থায়ী হবে, যতদিন আকাশমণ্ডলী ও যমীন বিলুপ্ত না হয়’’[3]। (সূরা হূদ-১০৮)
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِن تَتَّقُواْ ٱللَّهَ يَجۡعَل لَّكُمۡ فُرۡقَانٗا وَيُكَفِّرۡ عَنكُمۡ سَيِّ‍َٔاتِكُمۡ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡۗ﴾ [الانفال: ٢٩] 
‘‘হে ঈমানদারগণ, যদি তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে (আল্লাহ) তোমাদেরকে ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করার শক্তি দিবেন এবং তোমাদের পাপ মোচন করে দিবেন’’। (সূরা আল-আনফাল: ২৯)
বুদ্ধিমান লোকের সদা-সর্বদা সুখ-শান্তির অনুসন্ধান করে থাকে। আর এটা নিশ্চিত যে, সর্ব প্রকার সুখ-শান্তি পেতে হলে পবিত্র ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী জীবন-যাপন করতে হবে।

{প্রশ্ন: ৩} চারটি বিষয় সম্পর্কে প্রত্যেক মুসলিমের জ্ঞান লাভ করা অবশ্য কর্তব্য, তা কী কী?
উত্তর: বিষয় চারটি হলো:
(ক) ইলম বা জ্ঞান অর্জন করা। আর এ ইলমের সাহায্যে দলীল প্রমাণসহ আল্লাহ্, তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং দীন ইসলাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞানলাভ করা।
(খ) জেনে-বুঝে নেওয়া জ্ঞান অনুযায়ী আমল বা কাজ করা।
(গ) ইসলামী জীবন বিধানের দিকে অন্যদেরকে আহ্বান করা।
(ঘ) ইসলামী বিধি-বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করার সময়ে এবং এ বিধানের দিকে মানুষকে আহ্বান ও দীনের প্রচার করার সময় সম্ভাব্য বাধা-বিপত্তি, নিপিড়ন-নির্যাতন, কষ্ট এবং বিপদ-বিপর্যয়ে ধৈর্য ধারণ করা।[4]

{প্রশ্ন:৪} পূর্বে বর্ণিত বিষয় চারটির প্রমাণ দিন?
উত্তর: সূরা আল-আসর
﴿ وَٱلۡعَصۡرِ ١ إِنَّ ٱلۡإِنسَٰنَ لَفِي خُسۡرٍ ٢ إِلَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلۡحَقِّ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلصَّبۡرِ ٣ ﴾ [العصر: ١،  ٣] 
‘‘(১) আবহমান কালের কসম (২) মানুষ প্রকৃত পক্ষে বড়ই ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত (৩) তবে তারা ব্যতীত; যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ কাজ করেছে আর যারা পরস্পরকে নিরন্তর (সর্বদা) হক (সত্যনিষ্ঠ) উপদেশ এবং ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দিয়ে থাকে’’। (সূরা আল আসর)

{প্রশ্ন: ৫} আল্লাহ কি আমাদেরকে এ দুনিয়ার জীবনে অবহেলিত অবস্থায় রেখেছেন?
উত্তর: কখনই নয়; বরং তিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রয়োজনীয় সব রিযিকের ব্যবস্থাও করেছেন। আর আমাদের জন্য রাসূল পাঠিয়েছেন (জীবন বিধান দিয়ে)। সুতরাং যে তাঁর আনুগত্য অনুসরণ করবে সে জান্নাতে যাবে আর যে রসূলের নাফরমানী করবে সে জাহান্নামে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ إِنَّآ أَرۡسَلۡنَآ إِلَيۡكُمۡ رَسُولٗا شَٰهِدًا عَلَيۡكُمۡ ﴾ [المزمل: ١٥] 
‘‘আমি তোমাদের নিকট রাসূল পাঠিয়েছি তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ’’। (সূরা আল-মুয্যাম্মিল: ১৫)
মহান আল্লাহ আরো বলেন: 
﴿ أَفَحَسِبۡتُمۡ أَنَّمَا خَلَقۡنَٰكُمۡ عَبَثٗا وَأَنَّكُمۡ إِلَيۡنَا لَا تُرۡجَعُونَ ١١٥ ﴾ [المؤمنون: ١١٥] 
‘‘তোমরা কি মনে করেছ যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক অযথা সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে না?’’[5]।

{প্রশ্ন: ৬} আল্লাহ কি তার সাথে অন্য কাউকে শরীক করা পছন্দ করেন?
উত্তর : আল্লাহ কখনো তা পছন্দ করেন না। মহান আল্লাহ বলেন:
﴿وَلَا يَرۡضَىٰ لِعِبَادِهِ ٱلۡكُفۡرَۖ ﴾ [الزمر: ٧] 
‘‘তিনি (আল্লাহ) তাঁর বান্দাদের কুফরী পছন্দ করেন না’’। (সূরা আয-যুমার: ৭)
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
﴿ وَأَنَّ ٱلۡمَسَٰجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدۡعُواْ مَعَ ٱللَّهِ أَحَدٗا ١٨ ﴾ [الجن: ١٨] 
‘‘অবশ্যই মসজিদসমূহ আল্লাহরই জন্য। সুতরাং আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকে ডেকো না’’। (সূরা আল-জ্বিন: ১৮)
অতএব আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা প্রমাণ করে যে, তিনি কুফরী পছন্দ করেন না।

{প্রশ্ন: ৭} বর্তমান কালে মুসলিম বিশ্বে যে সব শির্ক সংঘটিত হচ্ছে তার কিছু উদাহরণ দিন?
উত্তর: যেমন: কবরের চতুর্দিকে তাওয়াফ করা, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো উদ্দেশ্যে বা নামে যবেহ করা, গায়ক-গায়িকা এবং নর্তকীদের পূজা ইবাদাত করা। দীন-ইসলাম এবং এর অনুসারীদের সাথে ঠাট্রা-বিদ্রূপ ও তামাসা করা ইত্যাদি।

{প্রশ্ন:৮} কাফের সম্প্রদায়ের ব্যাপারে মুসলিমদের দায়িত্ব-কর্তব্য বর্ণনা করুন?
উত্তর: (এক) তাদেরকে মুসলিমগণ মহান আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিবে এবং তাদের হেদায়াত ও কল্যাণ কামনা করবে।
(দুই) আর যদি আল্লাহর দিকে ডাকা বা আহ্বান করা সম্ভব না হয় তবে ঘৃনা-অবজ্ঞা করতে হবে এবং তাদেরকে উৎসাহিত করা যাবে না বা তাদের পূজা-পার্বন, ধর্মীয় উৎসবে অংশ নেওয়া, অভিনন্দন-শুভেচ্ছা জানানো সম্পূর্ণ অবৈধ। বরং স্পষ্টভাবে তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে তারা সত্য-সঠিক পথে নেই।[6]
(তিন) তারা যদি প্রকাশ্যে শত্রুতা-বিরোধিতা করে এবং যুদ্ধে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের সাথে জিহাদ করতে হবে আল্লাহর দীন কায়েম না হওয়া পর্যন্ত। সুতরাং যেখানেই মুসলিমরা সজাগ-সতর্ক থাকবে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণে ধর্মহীন এবং মূর্তিপূজকদের সরব উপস্থিতি সম্ভব হবে না।[7]

{প্রশ্ন:৯} সন্তান মুসলিম কিন্তু মাতা-পিতা কাফের হলে, সন্তানের কর্তব্য কী?
উত্তর: দুনিয়ায় তাদের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ وَإِن جَٰهَدَاكَ عَلَىٰٓ أَن تُشۡرِكَ بِي مَا لَيۡسَ لَكَ بِهِۦ عِلۡمٞ فَلَا تُطِعۡهُمَاۖ وَصَاحِبۡهُمَا فِي ٱلدُّنۡيَا مَعۡرُوفٗاۖ وَٱتَّبِعۡ سَبِيلَ مَنۡ أَنَابَ إِلَيَّۚ ﴾ [لقمان: ١٥] 
‘‘তোমার মাতা-পিতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সাথে শরীক করতে, যে বিষয়ে তোমার কোন ইলম (জ্ঞান) নেই, তখন তুমি তাদের কথা মানবে না। তবে দুনিয়াতে তাদের সাথে বসবাস করবে সৎভাবে। আর যে বিশুদ্ধচিত্তে আমার অভিমূখী হয়েছে তার পথকে অনুসরণ কর’’। (সূরা লুকমান: ১৫)
শুধুমাত্র ঈমান ও ইসলামের পরিপন্থী বিষয়ে তাদেরকে ভালোবাসা যাবে না এবং মান্য করবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন:
﴿ لَّا تَجِدُ قَوۡمٗا يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ يُوَآدُّونَ مَنۡ حَآدَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَوۡ كَانُوٓاْ ءَابَآءَهُمۡ أَوۡ أَبۡنَآءَهُمۡ أَوۡ إِخۡوَٰنَهُمۡ أَوۡ عَشِيرَتَهُمۡۚ ﴾ [المجادلة: ٢٢] 
‘‘তুমি পাবে না আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী এমন কোনো সম্প্রদায়, যারা ভালবাসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারীদেরকে, হোক না এ বিরুদ্ধাচারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা আত্মীয় বা জ্ঞাতি-গোত্র’’। (সূরা আল-মুজাদালাহ: ২২)
অর্থাৎ: শির্ক, কুফরী এবং আল্লাহর নাফরমানীমূলক কাজে মাতা-পিতা বা অন্য কারোই আনুগত্য বা অনুসরন করা যাবে না; কিন্তু তাদের সেবা-যত্ন সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে এবং খোজ-খবর নিতে হবে। হতাশ না হয়ে নিরলসভাবে তাদেরকে ইসলামের পথে ডাকতে হবে এবং কোনো অবস্থাতেই বিরক্ত হওয়া চলবে না।

{প্রশ্ন: ১০} মৃত্যু কিংবা পরিবার-পরিজনের ভয়ে অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হবার আশংকা হলে বা চাকুরি হারানের ভয়ে দীন ইসলাম গ্রহণ না করা জায়েয হবে কি?
উত্তর: কোনো অবস্থাতেই জায়েয হবে না। তবে যদি জীবন বিপন্ন হওয়ার আশংকা হয় তাহলে দীন গ্রহণের খবর প্রকাশ না করে, মুসলিম হবার পরিচয় গোপন রাখার অনুমতি আছে। যেমন: মহান আল্লাহ বলেন:
﴿إِلَّا مَنۡ أُكۡرِهَ وَقَلۡبُهُۥ مُطۡمَئِنُّۢ بِٱلۡإِيمَٰنِ ﴾ [النحل: ١٠٦] 
‘‘যার উপর জবরদস্তি করা হয় এবং তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে সে ব্যতীত’’। (সূরা আন-নাহল: ১০৬)

{প্রশ্ন: ১১} আল্লাহর সবচেয়ে বড় নির্দেশ এবং নিষেধ কী?
উত্তর: আল্লাহর সবচেয়ে বড় নির্দেশ দিয়েছেন তাওহীদ বা একত্ববাদের আর বড় নিষেধ করেছেন শির্ক তথা ‘আল্লাহর সাথে শরীক করা’ হতে। মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ ۞وَٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَلَا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡ‍ٔٗاۖ ﴾ [النساء: ٣٦] 
তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করবে ও কোনো কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না’’। (সূরা আন-নিসা:৩৬)

{প্রশ্ন: ১২} তাওহীদ এর পরিচয় কী এবং তাওহীদ কত প্রকার ও কী কী বর্ণনা করুন?
উত্তর: তাওহীদ হলো: আল্লাহকেই এককভাবে ইবাদাত করা।
আর তাওহীদ তিন প্রকার:
(১) প্রতিপালন এবং রক্ষনাবেক্ষন ও কর্তৃত্বে একত্ববাদ। আর তা হলো; ভালভাবে জেনে এবং বুঝে দৃঢ় বিশ্বাস করা যে আল্লাহই একক সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা এবং বিশ্বজগতের সার্বভৌম পরিচালক। এ প্রকারের তাওহীদ (সৃষ্টিকর্তা থেকে সৃষ্টির জন্য) তৎকালীন মুশরিকরাও স্বীকার করতো, তাই বলে তারা কিন্তু ইসলামের গণ্ডির মধ্যে প্রবেশ করতে পারে নি বা মুসলিম হতে পারে নি। আল্লাহ বলেন: 
﴿ وَلَئِن سَأَلۡتَهُم مَّنۡ خَلَقَهُمۡ لَيَقُولُنَّ ٱللَّهُۖ ﴾ [الزخرف: ٨٧] 
‘‘যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস কর কে তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তারা অবশ্যই বলবে ‘‘আল্লাহ’’। (সূরা আয-যুখরুফ: ৮৭)
আল্লাহর তাওহীদ বা একত্ববাদ খণ্ডিতরূপে বিশ্বাস করলে গ্রহণযোগ্য হয় না, কারণ আল্লাহ অবশ্যই স্বয়ংসম্পূর্ণ অতুলনীয় একক সত্তা।
(২) নাম ও গুণের তাওহীদ বা একত্ববাদ হলো; স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সর্বোচ্চ মহত্ব মর্যাদাসম্পন্ন আল্লাহর যে সব নাম-গুণের উল্লেখ কুরআন ও হাদীসে এসেছে সেগুলোর স্বীকৃতি প্রদান করা। আর তা হতে হবে কুরআন ও সহীহ হাদীসে যেভাবে আছে সেভাবেই। এ প্রকারের তাওহীদ কিছু সংখ্যক মুশরিকরা স্বীকার করে এবং অন্যরা অস্বীকার করে অজ্ঞতাবশত ও স্বেচ্ছাচারী একগুঁয়েমীর কারণে।
(৩) আল্লাহর ইবাদাতে তাওহীদ বা একত্ববাদ; আর তা হলো, একনিষ্ঠভাবে (খালেছভাবে) শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগী করা, তাঁর কোনো শরীক (অংশীদার) নেই। সর্বপ্রকারের ইবাদাত-বন্দেগী একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য। যেমন: ভালোবাসা, ভয়, ভীতি, আশা-আকাঙ্খা, নির্ভরশীলতা-ভরসা, দো‘আ-প্রার্থনা এবং আরো অন্যান্য ইবাদাত যা মুশরিক সম্প্রদায় কেবল আল্লাহর জন্য করতে অস্বীকার তথা অমান্য করে থাকে।[8]

{প্রশ্ন:১৩} আল্লাহর ইবাদাতের রুকন (স্তম্ভ) কয়টি ও কী কী?
উত্ত: রুকন হলো দু’টি; (১) সিদক (বস্তুনিষ্ঠ সত্যবাদিতা) (২) ইখলাস (বিশুদ্ধচিত্ত হওয়া)।
তন্মধ্যে বস্তুনিষ্ঠ সত্যবাদিতা হলো: অন্তর, জিহবা ও কাজের সমন্বয়ে দৃঢ় বিশ্বাসকে সত্যে পরিণত করা।
আর ইখলাস হলো: যাবতীয় কাজ-কর্মসমূহ নির্মল বিশুদ্ধ নিয়তের সাথে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই একনিষ্ঠভাবে সম্পন্ন করা; যাঁর কোনো শরীক নেই।[9]

{প্রশ্ন: ১৪} তিনটি মূলনীতি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা মানুষের অবশ্য কর্তব্য তা কী?[10]
উত্তর: তা হলো;
(১) বান্দাহ তার প্রতিপালক সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে
(২) বান্দাহ দীন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে
(৩) আল্লাহর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে জানবে।

{প্রশ্ন: ১৫} তোমার রব (প্রতিপালক) কে?
উত্তর: আমার প্রতিপালক আল্লাহ; যিনি আমাকে ও সমস্ত পৃথিবীকে তাঁর বিশেষ নিয়ামতসমূহ দ্বারা লালন-পালন করেন। তিনিই আমার মা‘বুদ (উপাস্য) তিনি ব্যতীত আমার আর কোন মা‘বুদ নেই। এর সমর্থনে আল্লাহর বাণী হলো:
﴿ ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٢ ﴾ [الفاتحة: ٢] 
‘‘সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহরই জন্য যিনি সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক’’। (সূরা আল-ফাতিহা: ১)
অতএব আল্লাহ ছাড়া সব কিছুই সৃষ্টজগত এবং আমিও সেই সৃষ্টজগতের একটি অংশ মাত্র।

{প্রশ্ন:১৬} কীভাবে আল্লাহকে চেনা (জানা) যায়?
উত্তর: (১) আল্লাহর সৃষ্টিসমূহকে পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনা করলেই আল্লাহকে চেনা ও জানা সহজ হবে। সৃষ্টজগতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, আধিপত্য, সৃষ্টিতত্ত্ব (কৌশল) নিদর্শন এবং অনুগ্রহসমূহ দেখে চিন্তা ভাবনা করলেই আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যাবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা বলেন:
﴿ أَوَلَمۡ يَنظُرُواْ فِي مَلَكُوتِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَمَا خَلَقَ ٱللَّهُ مِن شَيۡءٖ ﴾ [الاعراف: ١٨٥] 
‘‘তারা কি লক্ষ্য করে না, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌম কর্তৃত্ব সম্পর্কে এবং আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা সম্পর্কে’’। (সূরা আল-আ‘রাফ: ১৮৫)
অনুরূপভাবে মহান আল্লাহ সূরা আলে ইমরানের ১৯০ নং আয়াতে বলেন:
﴿ إِنَّ فِي خَلۡقِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَٱخۡتِلَٰفِ ٱلَّيۡلِ وَٱلنَّهَارِ لَأٓيَٰتٖ لِّأُوْلِي ٱلۡأَلۡبَٰبِ ١٩٠ ﴾ [ال عمران: ١٩٠] 
‘‘আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও দিবা-রাত্রির পরিবর্তনের মধ্যে অবশ্যই অনেক নিদর্শন বিদ্যমান আছে বোধশক্তিসম্পন্ন লোকদের জন্য’’।
(২) আল্লাহর অহী বা শরীয়তী বিধি ও বিধান সম্পর্কিত আয়াতসমূহ অনুধাবন করার মাধ্যমে আল্লাহকে চেনা যাবে। যেমন; মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَۚ وَلَوۡ كَانَ مِنۡ عِندِ غَيۡرِ ٱللَّهِ لَوَجَدُواْ فِيهِ ٱخۡتِلَٰفٗا كَثِيرٗا ٨٢ ﴾ [النساء: ٨٢] 
‘‘তবে কি তারা কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না? যদি তা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট থেকে আসত তবে তারা এতে অনেক অসঙ্গতি পেত’’ (সূরা আন-নিসা: ৮২)
(৩) মুমিন ব্যক্তি জেনে ও বুঝে অন্তর দিয়ে আল্লাহকে গ্রহণ ও স্মরণ করবে অতঃপর এমনভাবে আমল ও ইবাদাত করবে যেন সে আল্লাহকে  দেখছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহসান সম্পর্কে বলেন:
«أن تعبد الله كأنك تراه، فإن لم تكن تراه فإنه يراك».
‘‘তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদাত ইবাদাত করবে যেন তুমি আল্লাহকে দেখছো, আর যদি মনে কর তুমি আল্লাহকে দেখছ না, কিন্তু আল্লাহ অবশ্যই তোমাকে দেখছেন’’।[11]

{প্রশ্ন: ১৭} তোমার দীন কী?
উত্তর: আমার দীন হলো আল্লাহর মনোনীত আল-ইসলাম।

{প্রশ্ন:১৮} ইসলামের পরিচয় কী?
উত্তর: একত্ববাদের সাথে একমাত্র আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা। আল্লাহর নিরংকুশ আনুগত্য করা এবং শির্ক ও তার অনুসারীদের থেকে দূরে থাকা[12]।

{প্রশ্ন: ১৯} দীনের স্তর কয়টি ও কী কী?
উত্তর: দীনের স্তর তিনটি
(১) ইসলাম
(২) ঈমান
(৩) ইহসান (উত্তম পন্থা অবলম্বন ও সদ্বব্যবহার)[13]।

{প্রশ্ন: ২০} ইসলামের রুকন (স্তম্ভ) কয়টি ও কী কী?
উত্তর: ইসলামের রুকন পাঁচটি;
(ক) ঘোষণা দেওয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো সত্য ইলাহ (মা‘বুদ) নেই; আর এ ঘোষণা দেওয়া যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দাহ ও রাসূল।
(খ) সালাত (নামায) কায়েম করা
(গ) যাকাত আদায় করা
(ঘ) রমযান মাসে সওম (রোযা) পালন করা
(ঙ) আল্লাহর ঘরে গিয়ে হজ্জ আদায় করা।

{প্রশ্ন: ২১} ঈমান কাকে বলে? ঈমানের শাখা-প্রশাখা এবং রুকন কয়টি ও কী কী?
উত্তর: ঈমানের আভিধানিক অর্থ হলো: স্বীকার করা। আর পারিভাষিক অর্থ হলো:  মুখের স্বীকৃতি (ঘোষণা), অন্তরের বিশ্বাস এবং অংগ-প্রত্যংগ দিয়ে বাস্তবে কাজ করা। সৎ কাজের মাধ্যমে ঈমান বৃদ্ধি পায়, আর পাপ কাজ করলে ঈমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঈমানের শাখা-প্রশাখা সত্তরটিরও অধিক: এর সর্বোচ্চ শাখা হলো: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা। আর সর্ব নিকটস্থ শাখা হলো, পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূরে সরিয়ে দেওয়া। আর লজ্জা হলো ঈমানের শাখাসমূহের একটি[14]।
ঈমানের রুকন ছয়টি: পূর্ণ ঈমান আনয়ন করা (১) আল্লাহ (২) আল্লাহর ফেরেশতাগণ (৩) আল্লাহর কিতাবসমূহ (৪) তাঁর রাসূলগণ (৫) আখেরাত (পরকাল) দিবস এবং (৬) তাকদীরের ও মন্দের প্রতি। এর সমর্থনে দলীল হলো, আল্লাহর বাণী:
﴿ ۞لَّيۡسَ ٱلۡبِرَّ أَن تُوَلُّواْ وُجُوهَكُمۡ قِبَلَ ٱلۡمَشۡرِقِ وَٱلۡمَغۡرِبِ وَلَٰكِنَّ ٱلۡبِرَّ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ وَٱلۡكِتَٰبِ وَٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ ﴾ [البقرة: ١٧٧] 
‘‘সৎ কর্ম শুধু এ নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ করবে, বরং সৎ কাজ হলো এ যে ঈমান আনবে আল্লাহর উপর, আখেরাত দিবসের উপর, ফিরিশতাদের উপর, আসমানী কিতাবের উপর এবং নবী-রাসুলগণের উপর’’। (সূরা আল-বাকারা: ১৭৭)
আল্লাহ আরো বলেন: 
﴿ إِنَّا كُلَّ شَيۡءٍ خَلَقۡنَٰهُ بِقَدَرٖ ٤٩ ﴾ [القمر: ٤٩]  
‘‘আমরা প্রত্যেক বস্তুকে নির্ধারণ অনুসারে সৃষ্টি করেছি’’। (সূরা আল ক্বামার: ৪৯)

{প্রশ্ন: ২২} ইহসান কাকে বলে?
উত্তর:  ইহসান হলো: ‘‘আল্লাহর ইবাদাত করার সময় মনে করতে হবে যে,  তুমি আল্লাহকে দেখছো, আর যদি তুমি দেখতে না পাও তবে নিশ্চয়ই তিনি তোমাকে দেখছেন’’। (সহীহ আল-বুখারী)
মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلَّذِينَ ٱتَّقَواْ وَّٱلَّذِينَ هُم مُّحۡسِنُونَ ١٢٨ ﴾ [النحل: ١٢٨] 
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সাথে আছেন[15], যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা মুহসিন (সর্বোত্তমভাবে তাদের কর্ম করে)’’। (সূরা আন-নাহল: ১২৮)

{প্রশ্ন: ২৩} নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিচয় কী?
উত্তর:  তিনি হলেন, মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন আব্দুল-মুত্তালিব, ইবন হাশিম আল-কুরাশি আল-আরাবী ইসমাঈল ইবন ইবরাহীম আল- খলীলের বংশধর। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরুদ ও সালাম বর্ষিত হউক।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়ত পেয়েছেন ৪০ বৎসর বয়সে, আর নবুওয়তের পর ২৩ বছর জীবিত ছিলেন। অর্থাৎ ৬৩ বৎসর বয়সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা যান। এ ২৩ বৎসর কেটেছে নবী ও রাসূল হিসেবে। নবুওয়তের সূচনা হয়:
 ﴿ ٱقۡرَأۡ بِٱسۡمِ رَبِّكَ ٱلَّذِي خَلَقَ ١ ﴾ [العلق: ١] 
‘‘পড় তোমার সৃষ্টিকর্তা রবের নামে’’ (সূরা আল-আলাক্ব:১) এর মাধ্যমে।
আর রেসালতের (আল্লাহর পথে কাফেরদেরকে আহ্বানের) দায়িত্ব পালনের আদেশ পান সূরা আল-মুদ্দাস্‌সিরের প্রথম ৬ আয়াতের  মাধ্যমে। সেখানে আল্লাহ তাঁকে শির্কের ব্যাপারে সতর্ককারী এবং তাওহীদী (একত্ববাদ) দাওয়াতের পরিচালক বানিয়ে দেন। মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلۡمُدَّثِّرُ ١ قُمۡ فَأَنذِرۡ ٢ وَرَبَّكَ فَكَبِّرۡ ٣ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرۡ ٤ وَٱلرُّجۡزَ فَٱهۡجُرۡ ٥ وَلَا تَمۡنُن تَسۡتَكۡثِرُ ٦ ﴾ [المدثر: ١،  ٦] 
(১) হে বস্ত্রাবৃত (২) উঠুন, সতর্ক করুন (৩) এবং আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন (৪) আপনার পোষাক-পরিচ্ছেদ পবিত্র করুন (৫) অপবিত্রতাকে বর্জন করুন (৬) আর দয়া প্রদর্শন না করে আরও বেশি করে কাজ করুন। (সূরা আল-মুদ্দাসসির: ১-৬)
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ إِنَّآ أَرۡسَلۡنَٰكَ شَٰهِدٗا وَمُبَشِّرٗا وَنَذِيرٗا ٤٥ وَدَاعِيًا إِلَى ٱللَّهِ بِإِذۡنِهِۦ وَسِرَاجٗا مُّنِيرٗا ٤٦ ﴾ [الاحزاب: ٤٥،  ٤٦] 
‘‘হে নবী! আমরা আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষীপ্রদানকারী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে  এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারী, এক উজ্জ্বল প্রদীপরূপে’’। (সূরা আল-আহযাব: ৪৫-৪৬)

{প্রশ্ন: ২৪} নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উর্ধ্বাকাশে (মি‘রাজে) গমন করেন কখন এবং কীভাবে?
উত্তর: কতিপয় বিদ্বান ব্যক্তি বলেন যে, তিনি নবুওয়ত প্রাপ্তির দশ বৎসর পরে উর্ধ্বাকাশে মিরাজে গমন করেন। বস্তুত মি‘রাজের সঠিক সময়কাল নিয়ে বিভিন্নজন যে মতামত ব্যক্ত করেছেন তা দশের অধিক। তবে কেউই জোর দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের কথা বলতে পারেন নি সুষ্পষ্ট দলিল প্রমাণের অভাবে।
আর যেভাবে গমন করেন তা হলো নিম্নরূপ:
তিনি বুরাকে আরোহণ করে জিবরিল আলাইহিস সাল্লামের সাথে মক্কা হতে বায়তুল মুকাদ্দাস গিয়ে অন্যান্য নবীদের সাথে সালাত আদায়ের পর আকাশ পথে বেশ কিছু সংখ্যক নবীদের সাক্ষাৎ করেন। অতঃপর তিনি সিদরাতুল মুনতাহায় পৌছে শোভা-সৌন্দর্যে মুগ্ধ-অভিভূত হয়ে এর নিকটবর্তী হন। এ পর্যায়ে আল্লাহ সালাত ফরয করে দেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাত অবলোকন করেন। অতঃপর মক্কায় ফিরে এসে ফযরের সালাত আদায় করেন।[16]

{প্রশ্ন: ২৫} নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন পর্যায়ে ও কখন হিজরতের আদেশ পান এবং হিজরত অর্থ কি?
উত্তর: মুশরিকদের মাত্রাতিরিক্ত নিষ্ঠুরতা ও চাপের মুখে হিজরতের অনুমতি আসে নবুওয়ত প্রাপ্তির ত্রয়োদশ বর্ষের রবিউল আউয়াল মাসে।
হিজরতের আভিধানিক অর্থ হলো: পরিত্যাগ বা প্রস্থান করা।
পারিভাষিক অর্থ হলো: শির্ক প্রাধান্য দেশ বা জনপদ ত্যাগ করে ইসলামী দেশ বা জনপদে প্রস্থান করা।
শির্ক প্রধান দেশে বা জনপদে কুফরী বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠিত থাকে; ইসলামী বিধি-বিধান প্রচলন ও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না। যেমন; আযান, সালাত, জুমা, শরীয়তসম্মত ঈদ-উৎসব ইত্যাদি।[17]

{প্রশ্ন: ২৬} ইসলামী জিন্দেগীর অন্যান্য বিধি-বিধান যেমন: যাকাত, হজ্জ, জিহাদ, আযান এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ ইত্যাদি বিষয়ে কখন নির্দেশ জারী করা হয়?
উত্তর: এসব নির্দেশ জারী করা হয় মাদানী যুগে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় দশ বছর সময়কালে তাওহীদ বা একত্ববাদের দিকে দাওয়াতী অভিযান পরিচালনা করেন। আর মক্কী যুগের দশ বছর পরে (শেষদিকে) পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করা হয়।[18]

{প্রশ্ন: ২৭} নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুতে ইসলামের উপর কোনো প্রভাব পড়েছে কি?
উত্তর: তাঁর মৃত্যুতে দীনে ইসলামের উপর কোনো প্রভাব পড়ে নি। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেছেন কিন্তু দীন ইসলাম পূর্ণাঙ্গরূপে দুনিয়াবাসীর জন্যে রেখে গেছেন। তিনি উম্মতকে যাবতীয় কল্যাণের পথ দেখিয়ে গেছেন এবং সকল অকল্যাণের ব্যাপারে সতর্ক করে গেছেন।

{প্রশ্ন: ২৮} নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যে কল্যাণের পথ দেখিয়ে গেছেন এবং যে অকল্যাণ বা ক্ষতির ব্যাপারে সাবধান করেছেন তা কী?
উত্তর: কল্যাণের পথ হলো: তাওহীদ বা একত্ববাদ ও আল্লাহ যা কিছু সন্তুষ্টির সাথে পছন্দ করেন এবং ভালবাসেন।
আর ক্ষতিকর বিষয় হলো: শির্ক ও যা কিছু অপছন্দনীয় এবং প্রত্যাখ্যাত। যাবতীয় কল্যাণের কথা ও কাজের শ্রেষ্ঠতম বিষয় হলো তাওহীদ বা একত্ববাদ। তা সবই উপস্থাপিত এবং প্রমাণিত। ক্ষতিকর বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপদজনক হলো শির্ক, সে সম্পর্কেও যথাযথ সাবধান করা হয়েছে।

{প্রশ্ন: ২৯} নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাদের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়েছে? প্রমাণ দিন
উত্তর: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র মানুষ ও জ্বিন জাতির জন্যে প্রেরিত হয়েছেন। আল্লাহ উভয় জাতিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করাকে ফরয করে দিয়েছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা বলেন:
﴿ قُلۡ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنِّي رَسُولُ ٱللَّهِ إِلَيۡكُمۡ جَمِيعًا﴾ [الاعراف: ١٥٨] 
‘‘বলুন: হে মানবসকল, নিশ্চয় আমি তোমাদের সকলের জন্যেই রাসূল’’। (সূরা আল-আ‘রাফ: ১৫৮)
মহান আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দ্বারা দীনকে পূর্ণাঙ্গরূপে পেশ করেছেন।

{প্রশ্ন: ৩০} নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৃত্যুর প্রমাণ কী?
উত্তর: মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ إِنَّكَ مَيِّتٞ وَإِنَّهُم مَّيِّتُونَ ٣٠ ﴾ [الزمر: ٣٠] 
‘‘নিশ্চয়ই আপনার মৃত্যু হবে এবং তাদেরও সবার মৃত্যু হবে’’। (সূরা আয-যুমার: ৩০)

{প্রশ্ন:৩১} আল্লাহ রসূলগণকে কেন পাঠিয়েছেন? তাঁদের মধ্যে প্রথম এবং শেষ রাসূল কে?
উত্তর: আল্লাহ দুনিয়াবাসীদের কাছে রাসূলগণকে সুসংবাদ প্রদান ও সতর্ক করার জন্যে প্রেরণ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ رُّسُلٗا مُّبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى ٱللَّهِ حُجَّةُۢ بَعۡدَ ٱلرُّسُلِۚ ﴾ [النساء: ١٦٥] 
‘‘প্রেরিত রসূলগণ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী। রাসূল প্রেরণের পর যেন মানুষ আল্লাহর প্রতি কোনো অভিযোগ আরোপ করার অবকাশ না পায়’’। (সূরা আন-নিসা: ১৬৫)
আর প্রথম রাসূল নূহ আলাইহিস সালাম এবং শেষ রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মহামহিয়ান আল্লাহ বলেন:
﴿ ۞إِنَّآ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ كَمَآ أَوۡحَيۡنَآ إِلَىٰ نُوحٖ وَٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ مِنۢ بَعۡدِهِۦۚ ﴾ [النساء: ١٦٣] 
“নিশ্চয় আমরা আপনার প্রতি অহী প্রেরণ করেছি যেমন করে নূহ ও তার পরবর্তী নবীগণের নিকট অহী প্রেরণ করেছিলাম’’। (আন-নিসা: ১৬৩)
অনুরূপভাবে শাফা‘আত সংক্রান্ত সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«فَيَأْتُونَ نُوحًا، فَيَقُولُونَ: يَا نُوحُ، أَنْتَ أَوَّلُ الرُّسُلِ إِلَى أَهْلِ الأَرْض»
‘‘কেয়ামত দিবসে মানবমণ্ডলী নূহ আলাইহিস সালাম এর নিকট এসে তাকে বলবে আপনি প্রথম রাসূল যাকে পৃথিবীবাসীদের কাছে পাঠানো হয়েছিল’’। (বুখারী, হাদীস নং ৩৩৪০, মুসলিম হাদীস নং ১৯৪)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা বলেন:
﴿ مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٖ مِّن رِّجَالِكُمۡ وَلَٰكِن رَّسُولَ ٱللَّهِ وَخَاتَمَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَۗ وَكَانَ ٱللَّهُ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٗا ٤٠ ﴾ [الاحزاب: ٤٠] 
‘‘মুহাম্মাদ তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং তিনি শেষ নবী। আর আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বজ্ঞ’’। (সূরা আল-আহযাব: ৪০)

{প্রশ্ন:৩২} প্রত্যেক জাতির মধ্যেই কি রাসূল মনোনীত করা হয়েছে? এবং কেন?
উত্তর:  আল্লাহ তা‘আলা নূহ আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেক জাতির মধ্যে নির্দিষ্ট রাসূল মনোনীত করে দিয়েছেন। তারা উম্মতের লোকদেরকে এক আল্লাহর ইবাদাত করার আদেশ দিয়েছেন এবং তাগুতসমূহের ইবাদাত উপাসনা করতে বারণ করেছেন। আর এ রিসালাতের বাণী সতর্ককারীগণ তাদের কওমের বা সম্প্রদায়ের কাছে পৌছে দিয়েছেন। এ সতর্ককারীগণ তাদের সম্প্রদায়ের জন্যে সত্যের সাক্ষী হয়ে অভিযোগ অপবাদের কোনো সুযোগ রেখে যান নি। সুমহান আল্লাহ বলেন:
﴿ وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ ﴾ [النحل: ٣٦] 
‘‘অবশ্যই আমরা প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি এ জন্যে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত বন্দেগী করবে এবং তাগুতসমূহ হতে নিরাপদ দূরে থাকবে’’। (সূরা আন-নাহল:৩৬)
আল্লাহ আরো বলেছেন:
﴿وَإِن مِّنۡ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٞ ٢٤ ﴾ [فاطر: ٢٤] 
‘‘এমন কোনো জাতি বা সম্প্রদায় নেই যাদের মধ্যে কোনো সতর্ককারী প্রেরিত হয় নি’’। (সূরা ফাতির: ২৪)
বস্তুত এ সতর্ককারীগণ আল্লাহর ইবাদাতের দিকে আহ্বান করতেন এবং আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করতে নিষেধ করতেন।

{প্রশ্ন: ৩৩} তাগুতের পরিচয় কী?
উত্তর: তাগুত হলো; বান্দা কর্তৃক কোনো মা‘বুদ বা আনুগত্যকৃত কিংবা অনুসরণকৃতের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘনমূলক আচরণ করা[19]।

{প্রশ্ন: ৩৪} তাগুত কয়টি ও কী কী?
উত্তর: তাগুতের সংখ্যা অনেক। তবে এর মধ্যে প্রধানতম পাঁচটি হলো: 
(ক) আল্লাহর লা‘নতপ্রাপ্ত ইবলিস।
(খ) আল্লাহর সাথে অথবা আল্লাহ ব্যতীত অন্য যাদের ইবাদাত উপাসনা পারস্পরিক সন্তুষ্টির সাথে হয়ে থাকে।
(গ) যে ব্যক্তি নিজের পূজা-উপাসনার আহ্বান জানাবে। আর যে সীমালংঘন করে যথোপযুক্ত সম্মান-মর্যাদার অধিক শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করবে। যেমন: ফির‘আউন বা তার মত অন্য কেউ।
(ঘ) যে ব্যক্তি গায়েব জানার দাবী করবে সেও তাগুত। যেমন;  জ্যোতিষ, গণক, জাদুকর এবং অদৃশ্যলোক সম্পর্কে জানার দাবীদার ইত্যাদি।
(ঙ) আল্লাহর নাযিলকৃত সুস্পষ্ট বিধান ব্যতীত যারা অন্য বিধান অনুযায়ী বিচার ফায়সালা করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা বলেন:
﴿ وَمَن لَّمۡ يَحۡكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡكَٰفِرُونَ ﴾ [المائ‍دة: ٤٤] 
‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করে না, তারাই কাফের’’। (সূরা আল-মায়েদা: ৪৪)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿ وَمَن لَّمۡ يَحۡكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ ﴾ [المائ‍دة: ٤٥] 
‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করে না, তারা যালেম (সীমালঙ্ঘনকারী)’’। (সূরা আল মায়েদা: ৪৫)
তাছাড়াও সূরা আল-মায়েদার ৪৭ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ أَفَحُكۡمَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ يَبۡغُونَۚ وَمَنۡ أَحۡسَنُ مِنَ ٱللَّهِ حُكۡمٗا لِّقَوۡمٖ يُوقِنُونَ ٥٠ ﴾ [المائ‍دة: ٥٠] 
‘‘তবে কি তারা জাহিলী যুগের বিধি বিধান (শাসন ব্যবস্থা) কামনা করে?  আল্লাহ অপেক্ষা বিশ্বাসীদের জন্য সর্বোত্তম বিধানদাতা কে !?’’
তাগুতী তথা আল্লাহদ্রোহী রাষ্ট্র পরিচালক বা শাসকের বৈশিষ্ট্য হলো, সে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর বিধান ব্যতীত অন্য বিধান গ্রহণ করা হালাল বা বৈধ। অথবা আল্লাহর বিধান ব্যতীত অন্যের বিধানকে উত্তম বলে বিশ্বাস করে। অথবা উভয় বিধানকে সমপর্যায়ের (উভয় বিধানই শাসন কার্যের সমযোগী) বা আল্লাহর নাযিলকৃত শাসন প্রণালী বর্তমান কালের অনুপযোগী মনে করে।

{প্রশ্ন: ৩৫} আল্লাহ সমস্ত বান্দাদের উপর কি ফরয করে দিয়েছেন?
উত্তর: সকল তাগুতকে অস্বীকার ও অমান্য করা এবং মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান আনাকে ফরয করে দেওয়া হয়েছে। সুমহান আল্লাহ বলেন:
فَمَن يَكۡفُرۡ بِٱلطَّٰغُوتِ وَيُؤۡمِنۢ بِٱللَّهِ فَقَدِ ٱسۡتَمۡسَكَ بِٱلۡعُرۡوَةِ ٱلۡوُثۡقَىٰ لَا ٱنفِصَامَ لَهَاۗ ﴾ [البقرة: ٢٥٦] 
‘‘যে তাগুতকে অস্বীকার করবে ও আল্লাহর উপর ঈমান আনবে সে এমন এক মযবুত অবলম্বন আঁকড়ে ধরলো যা ভাঙ্গবে না’’। (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৫৬)
উক্ত আয়াতে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর প্রতিধ্বনি করা হয়েছে অর্থাৎ ঘোষণা দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মা‘বুদ (উপাস্য) নেই। হাদীসে বর্ণিত আছে যে,
«رَأْسُ الأَمْرِ الإِسْلَامُ، وَعَمُودُهُ الصَّلَاةُ، وَذِرْوَةُ سَنَامِهِ الجِهَادُ»
‘‘সব বিষয়ের প্রধান হলো ইসলাম এবং ইসলামের স্তম্ভ হলো সালাত। আর ইসলামের উঁচু শৃঙ্ঘ বা চূড়া হলো আল্লাহর পথে জিহাদ’। (বুখারী: ১১৭৯, মুসলিম: ৩০)
আর আল্লাহর প্রতি ঈমান হলো: মনে প্রাণে এ স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে যে আল্লাহ তা‘আলা রবুবিয়াতে এবং নামে ও গুণে সাদৃশ্যহীন একক সত্ত্বা। আর একমাত্র তিনিই ইবাদাত পাওয়ার অধিকারী।
আর তাগুতের সাথে কুফরী (অস্বীকার) করার নিয়ম হলো:
সর্বপ্রকার মূর্তি ছুড়ে ফেলতে হবে এবং সেগুলোকে বয়কট করতে হবে। অতঃপর সেগুলোর পূজা-উপাসনা এবং সেগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে।
‘ঊরওয়াতুল উসকা’ হলো: তাওহীদ বা একত্ববাদের ঘোষণা আর এটাই হচ্ছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্য মা‘বুদ বা উপাস্য নেই) এর তাৎপর্য।

{প্রশ্ন: ৩৬} ইবাদাতের পারিভাষিক অর্থ কি?
উত্তর: ‘ইবাদাত’ ব্যাপক অর্থবোধক একটি শব্দ। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালোবাসার সমম্বয়ে অনুষ্ঠিত প্রকাশ্য ও গোপনীয় যাবতীয় কথা ও কাজকে ইবাদাত বলে[20]।

{প্রশ্ন: ৩৭} মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ ۞وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعۡبُدُوٓاْ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنًاۚ ﴾ [الاسراء: ٢٣] 
এ আয়াতের ব্যাখ্যা করুন?
উত্তর: ‘‘আপনার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারোই ইবাদাত করবে না, আর মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে’’। (সূরা বানী ইসরাঈল:২৩)
উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, আদেশ দেওয়া হয়েছে একমাত্র তারই ইবাদাত করার জন্য এবং তাঁর কোনো শরীক নেই। আর মাতা-পিতার সাথে বিনয়-নম্র আচরণ করতে হবে, কেননা মাতা-পিতার শ্রদ্ধা-সম্মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহর ইবাদাতের পরেই এর স্থান। তারা মুশরিক হলেও সদ্ব্যবহার করতে হবে। মহান আল্লাহ সূরা লুকমানের ১৫ নং আয়াতে বলেন:
﴿ وَصَاحِبۡهُمَا فِي ٱلدُّنۡيَا مَعۡرُوفٗاۖ ﴾ [لقمان: ١٥] 
‘‘এবং দুনিয়ায় তাদের সাথে নম্র-ভদ্র এবং সদ্ভাব বজায় রাখবে’’।

{প্রশ্ন:৩৮} মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: বান্দার উপরে আল্লাহর হক হলো: তারা আল্লাহর ইবাদাত করবে কিন্তু তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করবে না। আর আল্লাহর কর্তব্য হলো যে বান্দা আল্লাহর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করবে না তাকে আযাব বা শাস্তি না দেওয়া’’। (মুত্তাফাকুন আলাইহি)
অতএব বান্দার উপরে আল্লাহর হক এবং আল্লাহর উপরে বান্দার হক এদূয়ের মধ্যে পার্থক্য কি? এ হাদীস হতে আমরা কী শিক্ষা পাই?
উত্তর: আল্লাহর হক বান্দার উপর ওয়াজিব বা বাধ্যতামূলক। পক্ষান্তরে আল্লাহর উপর বান্দার হক হচ্ছে যথোপযুক্ত প্রতিদান ও সম্মান।
হাদীসের যা শিক্ষণীয় তা হলো: আল্লাহর ইবাদাতে একত্ববাদ বজায় রাখা ওয়াজিব বা আবশ্যক। আল্লাহর রহমত, তাঁর দয়া দাক্ষিন্য, সম্মান মর্যাদা ও বদান্যতা সর্বোচ্চরূপে এবং সর্বত্র ব্যাপকভাবে তা বিস্তৃত হয়ে আছে।

{প্রশ্ন:৩৯} তাওহীদের কিছু ফযিলত বর্ণনা করুন?
উত্তর:
(ক) যে তাওহীদ বজায় রাখবে সে অন্যান্য দোষত্রুটির কারণে জাহান্নামে গেলেও ত্রুটি অনুযায়ী শাস্তি ভোগের পর তা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবে। চিরকাল জাহান্নামে থাকতে হবে না।
(খ) তাওহীদের মানদণ্ডে বান্দার সমস্ত কাজ বিচার-বিশ্লেষণ করে সওয়াব দেওয়া হবে।
(গ) কেবলমাত্র তাওহীদপন্থীরাই আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় লাভ করবে। তারা ইজ্জত ও সম্মানের অধিকারী হবে, হেদায়াত পাবে। তারা সার্বিক কল্যাণ অর্জন করবে। আল্লাহ সন্তুষ্টির সাথে তাদের তত্ত্বাবধান  করবেন।
(ঘ) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা তাওহীদপন্থী ঈমানদারদেরকে দুনিয়াতে বিপদ আপদ মুক্ত রাখবেন আর পরকালে তারা লাভ করবে উত্তম জীবন।

{প্রশ্ন: ৪০} তাওহীদের হাকীকত (তাৎপর্য) কি?  যে তাওহীদের তাৎপর্য অনুধাবন ও অনুসরণ করবে সে কী পুরস্কার পাবে?
উত্তর: সর্বপ্রকার শির্ক, বিদ‘আত, কুসংস্কার, মনগড়া কথা-কাহিনী ও পাপাচার মুক্ত নির্মল কর্মের নামই তাওহীদ বা একত্ববাদ। আর জেনে-বুঝে তাওহীদের শিক্ষানুযায়ী জীবন যাপন করতে  হবে।
আর যে ব্যক্তি তাওহীদের শিক্ষা ও তাৎপর্য বাস্তবায়ন করলো সে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাকে কোনোই শাস্তি পেতে হবে না।

{প্রশ্ন:৪১} মহান আল্লাহ বলেন: ﴿ إِنَّ إِبۡرَٰهِيمَ كَانَ أُمَّةٗ قَانِتٗا لِّلَّهِ حَنِيفٗا وَلَمۡ يَكُ مِنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ١٢٠ ﴾ [النحل: ١٢٠]  এ আয়াতের ব্যাখ্যা করুন এবং উম্মাতান, ক্বানেতান, ‘হানীফান’ এ শব্দগুলোর ভাবার্থ কি?
উত্তর: আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের যে কয়টি গুণ-বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন তা সত্যিকারের তাওহীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
(ক) ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম ছিলেন উম্মতের অনুসরণীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, সফল ইমাম ও শিক্ষক আর তাই হচ্ছে ‘উম্মাতান’ এর অর্থ।
(খ) তিনি ছিলেন সর্বদাই আল্লাহর অনুগত বান্দা আর তাই হচ্ছে ‘ক্বানেতান’ এর অর্থ।
(গ) তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ আল্লাহমুখী এবং আল্লাহর পরিপন্থী সবকিছুই বর্জনকারী। আর তাই হচ্ছে ‘হানীফান’ এর অর্থ।
(ঘ) তিনি কথায়, কাজে ও বিশ্বাসে মুশরিক ছিলেন না এবং পরিপূর্ণ ইসলামের সাথে শির্কমুক্ত সত্যিকারের বিশ্বাসের অধিকারী।[21]

{প্রশ্ন: ৪২} শির্ক কত প্রকার ও কী কী?
উত্তর: শির্ক দুই প্রকার:
(১) শির্কে আকবার বা বড় শির্ক: আল্লাহর ইবাদাতে অন্য কিছুকেই শরীক বা অংশীদার মনে করে সেগুলোর কাছে দো‘আ করা, কিছু কামনা করা, ভয় করা, আল্লাহর মতই সে সবকে ভালোবাসা অথবা অন্য যে কোনো প্রকারের ইবাদাতে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে সংযোগ করা। এ জাতীয় শির্কে যারা জড়িত হবে তাদের জন্যে জান্নাত হারাম হয়ে যাবে এবং জাহান্নামই হবে তাদের চিরস্থায়ী বাসস্থান।
(২) শির্কে আসগর বা ছোট শির্ক: সব ধরনের কথা ও কাজ যা বড় শির্কের দিকে নিয়ে যায়। যেমন: আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে হলফ বা কসম করা, সামান্য লোক দেখানো ইবাদাত করা এবং খালেসভাবে আল্লাহর জন্য ইবাদাত সম্পন্ন না করা।[22]

{প্রশ্ন: ৪৩} সু মহান আল্লাহ বলেন: ﴿ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُۚ ﴾ [النساء: ٤٨]   এ আয়াতের ব্যাখ্যা ও শিক্ষা কি?
উত্তর:  ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমা করবেন না, যে তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরিক করে। আর শির্ক ছাড়া অন্যান্য গুনাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দিবেন’’। (সূরা আন-নিসা: ৪৮)
অর্থাৎ মহামহিয়ান আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি মুশরিকদের শাস্তি মাফ করবেন না। কিন্তু শির্ক ছাড়া অন্যান্য গুনাহকারীদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা তাকে তিনি ক্ষমা করে দিবেন।
আয়াতের শিক্ষা হলো: শির্ক সবচেয়ে বড় গুনাহ। শির্ক হতে তওবা না করলে আল্লাহ শির্ককারীদেরকে মাফ করবেন না। শির্ক ছাড়া অন্যান্য গুনাহগারদের মধ্য থেকে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দিবেন আর যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিবেন।
অতএব শির্কের গুনাহকে আল্লাহর বান্দাদের অধিক ভয় করা উচিৎ। আল্লাহ চান যেন মানুষকে শির্কের ভয়াবহ পরিণতি বরণ করতে না হয়।

{প্রশ্ন: ৪৪} লোক দেখানো কাজ বা কপটতা তথা ‘রিয়া’ কী? এ বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবীদের জন্য কেন ভয় করতেন?
উত্তর:  ‘রিয়া’ শব্দটি ‘রুইয়াহ’ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। আভিধানিক অর্থ হলো কপটতা, প্রদর্শন করা বা লোক দেখানো কাজ করা। যে সব ভালো কাজ করা হয়ে থাকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন করে প্রশংসা পাওয়ার জন্য। এ রিয়াকারী কপটব্যক্তি বিশুদ্ধ নিয়তে ইবাদাত বা অন্যান্য কাজ করে না।
আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের ব্যাপারে এ জাতীয় রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করার কারণ হলো: এটি একদিকে মন্দ কাজের নির্দেশকারী নফসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং মনকে হঠাৎ মুগ্ধ বা আকৃষ্ট করে থাকে আর তা সহজেই মানুষের মনকে দুর্বল করে দেয়। যারা প্রশংসা পছন্দ করে তাদেরকে শয়তান রিয়ার সুযোগে সূক্ষ্মভাবে বিভ্রান্ত করে থাকে।

{প্রশ্ন: ৪৫} ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আল্লাহর সাথে শির্কে লিপ্ত থেকে যার মৃত্যু হবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’’। অন্য বর্ণনায় আছে ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কিছুকে আহ্বান করে মারা যাবে (সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে)’’ এ হাদিসের ব্যাখ্যা কি? এবং ‘‘যার মৃত্যু হবে’’ একথার দ্বারা কাদেরকে আলাদা (চিহ্নিত) করা হয়েছে। এখানে দো‘আর অর্থ কি এবং ‘নিদ্দ’ বলতে কি বুঝায়?
উত্তর:  নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়ে দিয়েছেন ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরিক করলো এবং তাওবা না করে শির্কে জড়িত অবস্থায় মারা গেলো সে জাহান্নামে প্রবেশ করল। ‘‘যার মৃত্যু হলো” এ বাক্য দ্বারা তাদেরকে আলাদা করা হয়েছে যারা মৃত্যুর পূর্বে তওবা সম্পন্ন করেছে। আর দো‘আর অন্তর্ভুক্ত বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হলো সর্বপ্রকার যিকির ও কোনো কিছু চাওয়া-প্রার্থনা।
তবে এখানে দো‘আর অর্থ হবে; যে কোনো প্রকার ইবাদাত বন্দেগী আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর জন্য সম্পন্ন করা।
আর ‘নিদ্দ’ হচ্ছে: সামঞ্জস্য, সমপর্যায়, অনুরূপ ও দৃষ্টান্ত।

{প্রশ্ন: ৪৬} জাবের রাদিয়াল্লাহ আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি শির্ক মুক্ত থেকে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে শির্কের সাথে সম্পর্ক রেখে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে সে জাহান্নামে যাবে’’। (মুসলিম নং ৯৩)  আল্লাহর সাথৈ সাক্ষাতের অর্থ কি  এবং কখন এ সাক্ষাৎ হবে? আর নেতিবাচক (لا) শব্দের ফায়দা কি?
উত্তর: আল্লাহর  সাথে সাক্ষাতের অর্থ হলো: আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়া এবং সাক্ষাৎ করা। আর এ সাক্ষাত হবে ক্বিয়ামত দিবসে। আর নেতিবাচক শব্দের ফায়দা হলো, নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে যা নিষিদ্ধ নয় তা নির্ধারণ ও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অর্থাৎ তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা। আর যে শির্কমুক্ত থেকে প্রকৃত তাওহিদবাদী অবস্থায় আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করবে এব সেই জান্নাতে যাবে।

{প্রশ্ন: ৪৭
উত্তর: দীন ইসলামের দাওয়াত দেওয়া ওয়াজিব বা অবশ্য কর্তব্য। একজন দা‘ঈকে দাওয়াতী কাজের সূচনায় তাওহীদ বা একত্ববাদ উপস্থাপন করতে হবে। কেননা তাওহীদ হচ্ছে সব ফরযের বড় ফরয বা ওয়াজিবসমূহের প্রধান ওয়াজিব। সব কাজের মূল ভিত্তিও তাওহীদ। বিশুদ্ধ তাওহীদ (একত্ববাদ) ছাড়া কোনো নেক কাজ কবুল করা হবে না। আর ইমাম আবু হানিফা (রাহমাহুমুল্লাহ) বিশুদ্ধ একত্ববাদের নাম দিয়েছেন শ্রেষ্ঠ ফিকাহ বা ‘আল-ফিকহুল আকবার’।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু‘আয রাদিয়াল্লাহু  আনহুকে বলেন:
«إِنَّكَ تَأْتِي قَوْمًا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ، فَادْعُهُمْ إِلَى شَهَادَةِ أَنَّ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللهِ»
‘‘তুমি কিতাবী জনসাধারণের কাছে যাবে তাদেরকে সর্বপ্রথম যে বিষয়ের দাওয়াত দিবে তা হলো; তারা যেন সাক্ষ্য দেয় যে নিশ্চয় আল্লাহ ছাড়া আর কোনো (সত্য) ইলাহ বা মা‘বুদ নেই এবং নিশ্চয় আমি (মুহাম্মদ) আল্লাহর রসূল’’। (সহীহ মুসলিম ১/৫৩, হাদীস নং ১৯)

{প্রশ্ন: ৪৮} সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘যে বলবে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ বা মা‘বুদ নেই এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য যা কিছুর পূজা ও উপসনা করা হয় সেগুলোকে অস্বীকার করবে: তার মাল-সম্পদ জীবন, নিরাপদ হবে। আর তার হিসাব হবে মহামহিয়ান আল্লাহর যিম্মায়’। (মুসলিম)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীসের মধ্যে ধন-সম্পদ ও জীবনের নিরাপত্তার যে শর্তারোপ করেছেন তা কি?
উত্তর: নিরাপত্তার দুটি শর্তারোপ করেছেন:
(এক) জেনে-বুঝে ইয়াকিন দৃঢ় বিশ্বাস এবং ভালোবাসা। আন্তরিকতার সাথে বলতে হবে ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্য ইলাহ বা মা‘বুদ নেই’।
(দুই) আল্লাহ ব্যতীত সর্বপ্রকার মূর্তি, সৌধ বা অন্য যা কিছুর ইবাদাত উপাসনা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় সেগুলোকে অস্বীকার ও বর্জন করা।

{প্রশ্ন:৪৯} ‘‘যে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলবে’’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ কথার উদ্দেশ্য কি?
উত্তর: অর্থাৎ যে ব্যক্তি জেনে-বুঝে এ কালেমাকে মেনে নিয়ে স্বীকারোক্তি করবে এবং কালেমার দাবী অনুযায়ী কাজ করবে ও কালেমার দলীল প্রমাণকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে।

{প্রশ্ন:৫০} ‘‘আল্লাহ ব্যতীত অন্য যা কিছুর ইবাদাত উপাসনা করা হয় তা অস্বীকার করা’’। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ কথার অর্থ কি?
উত্তর:  অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত মূর্তি, স্মৃতিসৌধ, ফিরিশতা নবী, আওলিয়া বা নেক লোকদের ইবাদাত উপসনা করতে অস্বীকার ও বর্জন করা। কাফেররা এ ধরনের মূর্তি, সৌধ বা ব্যক্তিদের ইবাদাত বন্দেগীতে লিপ্ত হতো অথচ তাতে আল্লাহর অনুমতি নেই। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ وَإِذۡ قَالَ ٱللَّهُ يَٰعِيسَى ٱبۡنَ مَرۡيَمَ ءَأَنتَ قُلۡتَ لِلنَّاسِ ٱتَّخِذُونِي وَأُمِّيَ إِلَٰهَيۡنِ مِن دُونِ ٱللَّهِۖ ﴾ [المائ‍دة: ١١٦] 
‘‘যখন আল্লাহ বলবেন, হে ঈসা ইবনে মারইয়াম, তুমিই কি মানুষকে বলেছো যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়াও আমাকে এবং আমার আম্মাকে ইলাহ-মাবুদ হিসেবে গ্রহণ করে নাও?” (সূরা আল-মায়েদাহ: ১১৬)
আল্লাহ সব ধরনের বস্তু কিংবা যে কোনো ব্যক্তির ইবাদাত উপাসনা নিষিদ্ধ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ وَلَا يَأۡمُرَكُمۡ أَن تَتَّخِذُواْ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةَ وَٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ أَرۡبَابًا﴾ [ال عمران: ٨٠] 
‘‘ফিরিশতা এবং নবীগণকে প্রতিপালকরূপে গ্রহণ করার জন্য তোমাদেরকে আদেশ করা হয়নি।’’ (সূরা আলে ইমরান: ৮০)

{প্রশ্ন:৫১} ‘‘তার মাল- সম্পদএবং জীবন হারাম হয়ে যাবে’’ এ কথার অর্থ কি?
উত্তর: অর্থ হলো: তার মাল-সম্পদ ভোগ-দখল করা এবং জীবন বিপন্ন করা কোনো মুসলিমের জন্য হালাল নয়, কেননা কালেমার স্বীকৃতি দিয়ে সে মুসলিম হয়েছে, আর দীন ইসলামে তার জীবন, সম্পদ এবং অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়ে গেছে।

{প্রশ্ন:৫২} ‘‘তার সকল দায়-দায়িত্ব আল্লাহর উপর সোপর্দ হলো’’ এ কথার ভাবার্থ কি?
উত্তর: যে ব্যক্তি তার কন্ঠে কলেমার সাক্ষ্য দিবে আখেরাতে তার হিসাব-নিকাশের দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করবেন স্বয়ং আল্লাহ। সাক্ষ্যদানে সে যদি সত্যবাদী হয় তাহলে আল্লাহ তাকে সুখময় জান্নাত দান করবেন। আর যদি মিথ্যাবাদী হয় তাহলে আল্লাহ তাকে পীড়াদায়ক শাস্তি দিবেন। তবে দুনিয়ায় বাহ্যিক অবস্থা অনুযায়ী মূল্যায়ন করতে হবে। কিন্তু আল্লাহ প্রত্যেকের গোপন বা প্রকৃত (আসল) অবস্থা অনুযায়ী আখিরাতে উপযুক্ত কর্মফল দিবেন। কালেমা পাঠ করার পরে কেউ তরবারীর শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলে অথবা দীন ইসলামের পরিপন্থী কোনো কাজ করলে তাকে হত্যা করা যাবে। যেমন; বিবাহিত জ্বিনা-ব্যভিচারকারী, স্বেচ্ছায়-স্বজ্ঞানে কাউকে হত্যাকারী, ডাকাতি, সন্ত্রাস ইত্যাদি।

{প্রশ্ন:৫৩} ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি; ‘‘অবৈধ বা ভ্রান্ত ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ, কবয এবং স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ভালোবাসা বজায় রাখার জন্য কোনো বস্ত্র ব্যবহার করা এসবই শির্ক’’। (মুসনাদে আহমাদ, আবু-দাউদ)
অনুরূপভাবে আব্দুল্লাহ ইবনে উকাইম রাদিয়াল্লাহ আনহু হতে মারফু সূত্রে বর্ণিত আছে ‘‘যে ব্যক্তি কোথাও তাবীয কবয ঝুলানো বা বাধলো তাকে ওগুলোর জিম্মায় সোপর্দ করা হবে’’। (আহমাদ, তিরমিযি) ঝাড়-ফুঁক কাকে বলে এবং তার হুকুম কী?
উত্তর: ঝাড়-ফুঁক যাকে আরবীতে ‘রুকা’ বলা হয়, যা ‘রুকিয়া’ শব্দের বহুবচন। রুকিয়া হলো; ঝাড়-ফুঁক ব্যবহার করে জ্বর, বিষাক্ত কিছুর দংশন, বেহুশ হওয়া ইত্যাদি রোগ ব্যাধি নিরাময় বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ কাজকে অপরিহার্য ঝাড়-ফুঁকমন্ত্র হিসেবে অভিহিত। আর তা দু প্রকার:
[১] জায়েয:- যে ঝাড়-ফুক শির্ক মুক্ত তা তিনটি শর্তে জায়েয হবে; যথা: (ক) শরীয়তসম্মত আরবী বাক্য দ্বারা বোধগম্য অথবা বৈধ দো‘আর সঠিক ভাবার্থ পাঠ দ্বারা।
(খ) আল্লাহর কালাম, আল্লাহর নাম ও গুণ দ্বারা অথবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসে উল্লিখিত বাক্য দ্বারা।
(গ) দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে যে, ঝাড়-ফুঁকের বিশেষ (স্বতন্ত্র) কোনো প্রভাব নেই বরং সবই আল্লাহর সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টির প্রভাবাধীন।
[২] পূর্বোক্ত পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোনো পন্থার ঝাড়-ফুঁক করা নাজায়েয। মানুষের উপকার ও কল্যাণের জন্য ঝাড়-ফুঁক চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া এবং বিনিময়ে কিছু (অর্থ) নেয়া জায়েয। তবে জাদু-টোনা, সাধু-সন্নাসী, গনক, ও বিদআতীদের সর্বপ্রকার বাজে কর্মকাণ্ড, কুসংস্কার এবং বিভ্রান্তি থেকে দূরে থাকতে হবে। টেপরেকর্ডার, মাইক এবং টেলিফোনের মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করা যাবে না। কেননা বৈধ উপায়ে ঝাড়-ফুঁক করা ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত; যে কোনো কাজ-কর্ম, ইবাদাত বন্দেগী শরীয়ত নির্ধারিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা অপরিহার্য। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবাদের অনুসরণের মধ্যে বহুবিধ কল্যাণ নিহিত, তথা: মহান আল্লাহর সাথে অন্য কিছুর শরীক না হওয়ার উপায় এবং দীন ইসলামে কোনো প্রকার বিদআতের অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ করাও সম্ভব হয়। সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহ রাববুল আলামীনের প্রশংসা করা ঈমানদারদের একান্ত কর্তব্য।

{প্রশ্ন:৫৪} তামায়েম বা তাবিয-তুমার বলতে কি বুঝায় এবং তাবিজের হুকুম কি?
উত্তর: ‘তামায়েম’ শব্দটি আরবী; যা ‘তামীমা’ শব্দের বহুবচন। অভিধানিক অর্থ হলো রক্ষা-কবচ। আর পারিভাষিক অর্থ হলো: যে সব বস্তু তাবিজ-তুমার আকারে (লোহা, তামা,কড়ি, কাঠ, পাথর ইত্যাদি) বাচ্চাদেরকে বদ নজর হইতে রক্ষা করার জন্য গলায় ঝুলানো হয় বা কোথাও বেঁধে রক্ষা-কবচ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দীন ইসলামে এ সব তাবিজ-তুমার নিষিদ্ধ, হারাম এবং বাতিল। কেননা আল্লাহ ছাড়া আর কেউই হেফাযত বা রক্ষা করতে পারে না[23]।

{প্রশ্ন: ৫৫} ‘তিওয়ালা’ কাকে বলে এবং তা কেন শির্কের অন্তর্ভুক্ত হবে?
উত্তর: ‘তিওয়ালা’ এক প্রকার জাদুমন্ত্র। ধারণা করা হয়ে থাকে যে, এ ধরনের জাদু-মন্ত্র ব্যবহার করলে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ভালোবাসা অটুট থাকে। আর শির্কের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণ হলো, আল্লাহ ব্যতীত এসব জাদু-মন্ত্রকে কল্যাণকর বা অকল্যাণ প্রতিরোধক হিসেবে গ্রহণ করা।

{প্রশ্ন:৫৬} পাথর এবং গাছ দ্বারা তাবাররুক গ্রহণের অর্থ কী? এ তাবাররুক গ্রহণের হুকুম কি?
উত্তর: পাথর এবং গাছ থেকৈ তাবাররুক অর্জনের প্রচেষ্টা করা শির্ক। কেননা ঐসব বস্তু ছুয়ে-স্পর্শ করে অথবা তার নিকটবর্তী হয়ে পানাহার করা কিংবা প্রার্থনা করা হয় বরকত লাভের নিয়তে। [অথচ এ গুলোতে কোনো বরকত রয়েছে বলে কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় নি]

{প্রশ্ন:৫৭} মহামহিয়ান আল্লাহ বলেন:
﴿ أَفَرَءَيۡتُمُ ٱللَّٰتَ وَٱلۡعُزَّىٰ ١٩ وَمَنَوٰةَ ٱلثَّالِثَةَ ٱلۡأُخۡرَىٰٓ ٢٠ ﴾ [النجم: ١٩،  ٢٠] 
‘‘(১৯) তোমরা কি ভেবে দেখেছ ‘‘লাত ও উযযার অবস্থা সম্বন্ধে? (২০) এবং তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্পর্কে?’’ (সূরা আন-নাজম) এ আয়াতে উল্লেখিত নামগুলো কিসের এবং এ নামকরণের উদ্দেশ্য কি? আয়াতের ব্যাখ্যা কি?
উত্তর: লাত, উযযা এবং মানাত এ তিনটি জাহেলী (অজ্ঞতা, অন্ধকার) যুগের মুশরিকদের দেব-দেবীর নাম। মুশরিকরা এগুলোর ইবাদাত উপাসনা করতো। ‘‘আফরাআইতুম’’ অর্থাৎ তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে ইলাহ বানিয়ে ইবাদাত করছো তাদের দ্বারা কারো উপকার বা অপকার হতে দেখেছো? অতঃপর ঐ সব বস্তুকে মহীয়ান গরিয়ান আল্লাহর শরীক বানানো যেতে পারে কি?
‘আল-লাত’ শব্দের ‘তা’ তাশদীদ বিহিন পড়লে অর্থ হবে, তৎকালিন তায়েফে অবস্থিত বড় একটি পাথর। এ পাথর কেন্দ্রিক ঘর তৈরী করে তার উপরে আবার কাপড়ের পর্দা ঝুলানো হয়। এ স্থানকে সাকিফ গোত্র সম্মান করত। (মক্কা বিজয়ের পর) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ স্থানে মুগিরা ইবনে শু‘বা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে প্রেরণ করেন, মুগিরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ঐ পুজা মন্ডুপ ভেঙ্গে চুরমার করে আগুন জ্বালিয়ে দেন। মুশরিক সম্প্রদায় আল-ইলাহ হতে আল-লাত শব্দ উদ্ভাবন করেছে। পক্ষান্তরে ‘আল-লাত’ শব্দের ‘তা’ বর্ণে তাশদীদ দিয়ে পাঠ করলে অর্থ হবে একজন ভালো লোকের নাম। ঐ ব্যক্তি হাজীদের ছাতুতে পানি মিশিয়ে দিত বা হাজীদেরকে সাহায্য করত। সে মারা গেলে লোকজন তার কবরের কাছে জড়ো হয়ে বাড়াবাড়ির এক পর্যায়ে মৃত ব্যক্তির পূজা-বন্দেগী শুরু করে দেয়। আলোচিত ব্যাখ্যা দুটির মধ্যে কোনো বৈপরিত্ব নেই।
‘আল-উয্যা’ হচ্ছে, মক্কা ও তায়েফের মধ্যস্থিত ‘নাখলা’ উপত্যকার একটি গাছ। কুরাইশরা এটাকে পূজা-ইবাদাত উপাসনা এবং তাজিম করত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন এটাকে ধ্বংস করার জন্য খালিদ ইবন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহুকে প্রেরণ করেন এবং তা ধ্বংস করা হয়। উয্যা শব্দটি আরবী ‘ঈযযা’ বা সম্মান-ইযযত ধাতু হতে গৃহীত।
আর ‘মানাত’ হচ্ছে মক্কা ও মদিনার মধ্যস্থিত একটি প্রকাণ্ড পাথর। এটাকে আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় ভক্তি সম্মান-তাজিম করত। মানাত শব্দটি আল-মান্নান বা ‘সর্বশ্রেষ্ঠ হিতকারী’ যা আল্লাহর নাম হতে গ্রহণ করা হয়েছে। কথিত আছে যে ঐ পাথরের কাছে জাহেলী যুগের লোকেরা বরকতের জন্য জীব-জন্তুর রক্ত প্রবাহিত (যবাই) করে মন বাসনা পূরণের আশা করতো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের বৎসর ঐ স্থানে আলী ইবনে আবী তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে প্রেরণ করেন, অতঃপর তিনি তা ধ্বংস করে দেন[24]।

{প্রশ্ন:৫৮} মহামহিয়ান আল্লাহ বলেন:
﴿ قُلۡ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحۡيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٦٢ لَا شَرِيكَ لَهُۥۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرۡتُ وَأَنَا۠ أَوَّلُ ٱلۡمُسۡلِمِينَ ١٦٣ ﴾ [الانعام: ١٦٢،  ١٦٣] 
‘‘(১৬২) বলুন অবশ্যই আমার নামায, আমার হজ্জ-কুরবানী-ইবাদাত, আমার জীবন, আমার মৃত্যু শুধুমাত্র আল্লাহ রাববুল আলামীনের জন্যই। (১৬৩) তার কোনো শরীক বা অংশীদার নেই, আমি ঐ সবের জন্যই আদিষ্ট হয়েছি এবং মুসলিমগণের মধ্যে আমিই প্রথম’’। (সূরা আল আন‘আম)
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
 ﴿ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنۡحَرۡ ٢ ﴾ [الكوثر: ٢] 
‘‘তুমি আল্লাহরই জন্য সালাত পড় এবং যবেহ কর’’। (কাওসার ২)
 উল্লেখিত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা কি? আর নুসুক বলতে কি বুঝায়?
উত্তর: প্রথম আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, হে মুহাম্মাদ! আপনি বলুন ঐ সব মুশরিক সম্প্রদায়কে যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের ইবাদাত, উপাসনা এবং অন্যদের জন্য প্রশু যবেহ করে থাকে। অবশ্যই আমি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য আমার সালাত ইবাদাত যবাই কুরবানী, জীবনে বেঁচে থাকা এবং ঈমানের সাথে নেক কাজে জড়িতাবস্থায় যেন আমার মৃত্যু হয়। সব কিছুই লা-শরীক আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টির জন্য সম্পন্ন করতে আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আর সব কিছুই নিষ্ঠার সাথে সম্পন্ন করার জন্য আমি আদিষ্ট এবং এ উম্মতের মধ্যে আমিই প্রথম মুসলিম।
আর ‘নুসুক’ হচ্ছে কুরবানী বা যবাই।
আর সূরা আল কাওসারের দ্বিতীয় আয়াতের ভাবার্থ হচ্ছে; সালাত ইবাদাত এবং কুরবানী একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্যই সম্পন্ন করতে হবে। সর্বাবস্থায় মুশরিকদের বিরুদ্ধাচারণ করতে হবে[25]।

{প্রশ্ন:৫৯} আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে চারটি কথা বলেছেন:
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাহারো জন্য যবেহ করে তার জন্য আল্লাহর লা’নত (অভিশাপ বা ধ্বংস),
যে ব্যক্তি তার মাতা-পিতাকে অভিশাপ দিবে তার জন্যেও আল্লাহর অবিশাপ বা ধ্বংস,
যে ব্যক্তি বিদ‘আত-ভ্রষ্টতাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিবে তার জন্যেও আল্লাহর অভিশাপ-ধ্বংস,
যে ব্যক্তি যমীনের (মালিকানা নির্ধারক) নিদর্শন (চিহ্ন) পরিবর্তন করবে তাকেও আল্লাহ ধ্বংস করে দিবেন’’ (মুসলিম নং ১৯১৮)
হাদীসে বর্ণিত আল-লা‘ন শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: আল-লা‘ন আল্লাহর পক্ষ থেকে হলে তার অর্থ হবে;  আল্লাহর রহমত থেকে বিতাড়িত এবং বঞ্চিত হওয়া। আর আল-লা‘ন সৃষ্টির পক্ষ থেকে হলে অর্থ হবে; গালি ও ক্ষতিকর দো‘আ।

{প্রশ্ন: ৬০} যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে যবেহ করবে তাকে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন লা‘নত দিয়েছেন?
উত্তর: কেননা সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর উদ্দেশ্যে যবাই করে এমন এক গুনাহ করেছে যা অনেক বড়; আর তাহলো আল্লাহর সাথে শির্ক।

{প্রশ্ন:৬১} মাতা-পিতাকে লা‘নত করার অর্থ কি? তাদেরকে কীভাবে লা‘নত করা হয়? তাদেরকে লা‘নত করার হুকুম কি?
উত্তর:  মাতা বা পিতাকে গালি দেওয়া বা মন্দ কথা বলা। তাদেরকে দুটি প্রক্রিয়ায় লানত করা হয়:
(ক) সরাসরি গালি দেওয়া, মন্দ কথা বলা; মাতা-পিতা উভয়কে অথবা যে কোনো একজনকে।
(খ) ভায়া বা ভিন্ন উপায়ে বা পরোক্ষ ভাবে গাল-মন্দ শুনানো যেমন; এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির পিতাকে গালি-মন্দ করার ফলে দ্বিতীয় ব্যাক্তি প্রতিশোধমূলক পূর্বোক্ত ব্যক্তির পিতাকে গালি-মন্দ করবে। মাতা-পিতাকে গালি-মন্দ করা কবীরা গুনাহ।

{প্রশ্ন:৬২} ‘‘আওয়া মুহদিসান’’ অর্থ কি? মুহদিস কাকে বলে?
উত্তর: ‘আওয়া’ অর্থ দীনের দুশমনকে সাহায্য করা, তার সাথে নিজকে শামিল করা, তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া এবং সত্যকে উপলব্ধি করে তা গ্রহণ করার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা।
‘মুহদিস’ হচ্ছে সে, যে ব্যক্তি মনগড়া কোনো কিছুকে দীনের মধ্যে শামিল করে। অতঃপর তা আল্লাহর অধিকারকে বিভ্রান্ত করে দেয় ও দুনিয়ায় বিপর্যয় সৃষ্টি করে।
রাষ্ট্র পরিচালক বিধি সম্মত পন্থায় মহান আল্লাহর বিধানসমূহ বাস্তবায়ন করার আহ্বান জানাবে, যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান ছাড়া অন্য কোনো উপায় অনুসন্ধান করে সেও মুহদিস।

{প্রশ্ন: ৬৩} মানারুল আরদ কি? এবং মানারুল আরদের পরিবর্তন করার অর্থ কি?
উত্তর: মানারুল আরদ হচ্ছে জমি-জমার সীমানায় পরিবর্তন ঘটানো, সীমানার চিহ্ন অপসারণ একটার বদলে অন্যটাকে গ্রহণ। পৃথিবীর প্রান্ত সীমা ও নিদর্শনসমূহ মানারুল আরদের অন্তর্ভুক্ত।
কেউ কেউ বলেন এটি এমন এক নিদর্শন যার মাধ্যমে ভ্রমণ, সফর কালে পথ খুজে পাওয়া যায়।
আবার কেউ বলেন: যার সাহায্যে একজন মানুষের অধিকার এবং তার প্রতিবেশীর অধিকারের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারিত হয়। অতঃপর তাদের প্রাপ্য অধিকার আগ-পিছ করে বদলে দেওয়া।

{প্রশ্ন:৬৪} যে মানারুল আরদ বদলে দিবে তাকে কেন ল’নত করা হলো?
উত্তর: কেননা সে মুসাফিরদের পথ হারাবার কাজে জড়িত হয়েছে কিংবা তার প্রতিবেশীর জমি অনাধিকার ভোগ-দখলে নিয়ে বড় ধরনের পাপ করেছে।

{প্রশ্ন: ৬৫} মান্নতের আভিধানিক ও পরিভাষিক অর্থ কি?
উত্তর: আভিধানিক অর্থ হলো বাধ্য হওয়া। পারিভাষিক অর্থে: স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে যথোপযুক্ত বয়সে নিজকে কোনো কিছু পালনে বাধ্য করা যা শরীয়ত নির্ধারিত বাধ্যতামূলক কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত নয়।
মহামহিয়ান আল্লাহ বলেন:
﴿ يُوفُونَ بِٱلنَّذۡرِ﴾ [الانسان: ٧] 
‘‘তারা মানতসমূহ আদায় করে’’। (সূরা আল ইনসান বা আদ-দাহর:৭)

{প্রশ্ন:৬৬} পূর্বোক্ত আয়াত কি বিষয়ে প্রমাণ করে?
উত্তর:  মানত করা শরীয়তে বৈধ এবং মানতকারীকে প্রশংসা করা হয়েছে।

{প্রশ্ন: ৬৭} আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত আছে; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্যমূলক মানত করবে সে যেন তা পালন (বাস্তবায়ন) করে,  আর যে ব্যক্তি আল্লাহর নাফরমানীমূলক মানত করবে সে যেন তা পালন না করে’’। (বুখারী নং ২০৫৪ মুখতাসার যুবাইদি পৃ: ৭০৩)।
এ হাদীসের ব্যাখ্যা কি এবং শিক্ষণীয় কি?
উত্তর: রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  আদেশ করেন:  যে ব্যক্তি মানতের মাধ্যমে নেক কাজ  করার জন্য নিজকে দায়বদ্ধ করলে সে যেন তা সুষ্ঠুভাবে পালন করে। কেননা আল্লাহর আনুগত্যমূলক কাজ সম্পন্ন করা ওয়াজিব বা অবশ্য কর্তব্য। আর যে ব্যক্তি কোনো প্রকার গুনাহর কাজ করার জন্য মানত করবে সে যেন তা সম্পন্ন না করে। কেননা আল্লাহর নাফরমানী করা হারাম।
হাদীস থেকে শিক্ষনীয় বিষয়গুলো নিম্নরূপ:
(১) যে কোনো প্রকার নেক মানত পালন করা ওয়াজিব বা অবশ্য কর্তব্য।
(২) নাফরমানীমূলক বা যে কোনো প্রকার গুনাহর মানত সম্পন্ন করা জায়েয হবে না।

{প্রশ্ন: ৬৮ ‘‘আল-ইসতি‘আযাহ’’ কাকে বলে? আল-ইয়ায ও লিয়ায এর মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর: আল-ইসতিআযা হচ্ছে; পানাহ, পরিত্রাণ এবং মযবুত অবলম্বন।
আল-ইয়ায এবং লিয়ায এর মধ্যে প্রার্থক্য; আল-ইয়ায হচ্ছে: আশ্রয়-অবলম্বন করা, অনিষ্ট ও ক্ষতি প্রতিরোধের জন্যে। আল-লিয়ায হচ্ছে: আশ্রয় সুযোগ গ্রহণ করা কল্যাণ অর্জনের জন্যে।

{প্রশ্ন:৬৯} মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ وَأَنَّهُۥ كَانَ رِجَالٞ مِّنَ ٱلۡإِنسِ يَعُوذُونَ بِرِجَالٖ مِّنَ ٱلۡجِنِّ فَزَادُوهُمۡ رَهَقٗا ٦ ﴾ [الجن: ٦] 
‘‘মানুষের মধ্য থেকে কতিপয় লোক জ্বিন সম্প্রদায়ের মধ্যস্থিত কিছু জ্বিনের আশ্রয় নিতো। ফলে ঐ মানুষগুলো জ্বিনদের মান মর্যাদা আত্মন্তরিতা বাড়িয়ে দিতো’’। (সূরা আল-জ্বিন:৬)
এ আয়াতের ব্যাখ্যা কী? এ আয়াত থেকে কী জানা গেল বা কী প্রমাণিত হলো?
উত্তর: জাহেলীযুগের আরব ব্যক্তি জন-মানবহীন কোনো উপত্যকায় গিয়ে বা অপরাহ্নে অবস্থান করার সময় ভয় পেত এবং বলত যে; এ উপত্যকায় যারা আছে আমি তাদের নেতার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। অর্থাৎ জ্বিনদের নেতা। আর জ্বিনেরা যখন দেখলো যে,  মানুষ তাদেরকে ভয় করে এব তাদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তখন তাদের মধ্যে আত্মভরিতা অহংকার ও প্রতাপ-দাপট বৃদ্ধি পেল, আর তাদের ব্যাপারে মানুষের ভয়-ভীতি এবং আতংক বৃদ্ধি পেল।
এ আয়াত হতে জানা গেল যে; রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থাপিত দীনে হক জেনে-বুঝে গ্রহণকারী ঈমানদার জ্বিন সম্প্রদায় জাহেলী (বেদীন) অবস্থায় যেসব পাপাচারে লিপ্ত হত কিংবা শির্ক করত এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর আশ্রয় সাহায্য প্রার্থনা করত, তারাই মহান আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর আশ্রয় ও সাহায্য প্রার্থনা করত, এখানে মহান আল্লাহ সে কথাই বিবৃত করেছেন[26]।

{প্রশ্ন: ৭০} খাওলা বিনতে হাকীম রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি; যে ব্যক্তি কোনো বাসা-বাড়িতে প্রবেশ করে পাঠ করে: ‘‘আউযু বি কালিমাতিল্লাহিততা-ম্মাতি মিন শাররী মা খালাকা’’ এ বাড়িতে অবস্থান কালে ঐ ব্যক্তির কোনো ক্ষতি হবে না। (মুসলিম-২৭০৮)
হাদীসের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো কী কী? ‘কালিমাতিল্লাহি’ দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে এবং আত-তাম্মাত অর্থ কী?
উত্তর: হাদীসের শিক্ষনীয় বিষয় নিম্নরূপ;
(১) আল্লাহ তা‘আলা দীন ইসলামের অনুসারীদেরকে আশ্রয় প্রার্থনা করার বৈধ উপায় জানিয়ে দিয়েছে। অতঃপর কেউ যেন জাহিলী যুগের অজ্ঞলোকদের মত জ্বিনদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা না করে।
(২) হাদীসে বর্ণিত দো‘আর ফযিলত বা উপকারিতা জানা গেল।
[‘কালিমাতিল্লাহি’ দ্বারা] আল কুরআনের কথা বলা হয়েছে। আত-[তা-ম্মা-ত’ অর্থ]: পুর্ণাংগ বা সম্পূর্ণ, তাতে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি অপূর্ণতা বা ঘাটতি নেই। আবার কেউ কেউ বলেছেন, সর্ববিষয়ে সর্বোচ্চ প্রয়োজন পূরণকারী। তবে মানুষের রচিত পুস্তকাদি ত্রুটি-বিচ্যুতি মুক্ত নয় এবং পূর্ণাঙ্গ নয়।

{প্রশ্ন:৭১} আল-ইসতিগাসা কী? ইসতিগাসা এবং দো‘আর মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর: আল-ইসতেগাসা হচ্ছে, বিপদে-আপদে আক্রান্ত হয়ে সাহায্য প্রার্থনা করা।
ইসতিগাসা এবং দো‘আর মধ্যে পার্থক্য: ইস্তিগাসা বিশেষভাবে বিপদ-আপদ আক্রান্ত হয়ে সাহায্য প্রার্থনা করা আর দো‘আ বিপদ-আপদ ছাড়াও যে কোনো প্রয়োজনে যখন ইচ্ছা করা হয়ে থাকে।

{প্রশ্ন:৭২} সাহায্য বা আশ্রয় প্রার্থনা কয় প্রকার এবং প্রত্যেকটির ধরণ-প্রকৃতি ও হুকুম কি?
উত্তর:  সাহায্য বা আশ্রয় প্রার্থনা দুই প্রকার;
(ক) শরীয়তসম্মত বৈধ ইস্তিগাসা
(খ) শরীয়ত পরিপন্থী নিষিদ্ধ ইস্তিগাসা।
নিষিদ্ধ ইসতিগাসা: আল্লাহ ছাড়া এমন কারো সাহায্য আশ্রয় চাওয়া বা ধর্ণা দেওয়া যার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। যেমন; মৃত ব্যক্তির নিকট আবেদন নিবেদন, সাহায্য চাওয়া।
অতএব সার্বিক বিশ্লেষণে ইসতিগাসা তিন প্রকার:
(এক) আল্লাহর নিকট চাওয়া বা ধর্ণা দেওয়া। খালেছভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলার কাছে ধর্ণা দেওয়া এবং অন্য সবকিছু অগ্রাহ্য করা অবশ্য কর্তব্য।
(দুই) আল্লাহ ছাড়া মৃত, অনুপস্থিত বা অন্য যাদের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয় তাদের কাছে বিপদ-আপদে অথবা যে কোনো সাহায্য চাওয়া হারাম; কেননা তা শির্ক।
(তিন) যে জীবিত এবং সাহায্য ও উপকার করতে সক্ষম তার কাছে আবেদন নিবেদন করা কিংবা ধর্ণা দেওয়া জায়েয বা বৈধ।[27]

{প্রশ্ন: ৭৩} দো‘আ কত প্রকার ও কী কী এবং তার পরিচয় কী?
উত্তর: দো‘আ দুই ভাগে বিভক্ত; উভয় প্রকার দো‘আ মহান আল্লাহর ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত:
(এক) ইবাদাতের মাধ্যমে দো‘আ:
আর তা হচ্ছে সর্বপ্রকার নেক কাজের দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা। মহান আল্লাহ নামায, হজ্জ এবং অন্যান্য ইবাদাত বন্দেগী নির্ধারিত নিয়মে পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন। বৈধ উপায়ে আল্লাহর তাজীমের উদ্দেশ্যে যে সব প্রশংসা করা হয় তা সবই ইবাদাত। যেমন; সূরা ফাতিহা পাঠ; সালাতের দো‘আসমূহ, হজ্জপালন, রোজা রাখা এবং অন্যান্য যিকিরসমূহ পালন।
(দুই) চাওয়ার মাধ্যমে দো‘আ: কোনো কিছু প্রাপ্তির জন্য দো‘আ করা, সেটা হতে পারে কোনো কল্যাণের জন্য দো‘আ অথবা বিপদ মুক্তির মুক্তির জন্য দো‘আ।

{প্রশ্ন: ৭৪} মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ وَمَنۡ أَضَلُّ مِمَّن يَدۡعُواْ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَن لَّا يَسۡتَجِيبُ لَهُۥٓ إِلَىٰ يَوۡمِ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَهُمۡ عَن دُعَآئِهِمۡ غَٰفِلُونَ ٥ وَإِذَا حُشِرَ ٱلنَّاسُ كَانُواْ لَهُمۡ أَعۡدَآءٗ وَكَانُواْ بِعِبَادَتِهِمۡ كَٰفِرِينَ ٦ ﴾ [الاحقاف: ٥،  ٦] 
‘‘(৫) সে ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত কে যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে, যা কিয়ামত দিবস পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিবে না। তারা এদের দো‘আ সম্পর্কে অবগতও নয় (৬) হাশরের মাঠে যখন মানুষদেরকে তাদের একত্রিত করা হবে, তখন এগুলো তাদের শত্রু হবে (এ উপাস্য দেবতাগুলো)। আর তারা এদের দ্বারা কৃত ইবাদাত অস্বীকার করবে’’। (সূরা আল আহকাফ: ৫,৬) এ আয়াতের ব্যাখ্যা কী?
উত্তর:  এ আয়াতে আল্লাহ ছুবহানাহু ওয়াতা‘আলা বলেছেন যে,  আল্লাহ ছাড়া যে অন্য কিছুকে ডাকে তার চেয়ে অধিক বিভ্রান্ত আর কেউ নেই। আল্লাহ আরো জানাচ্ছেন যে, কিয়ামত পর্যন্তও অন্য কেউই ডাকে সাড়া দিতে সক্ষম হবে না এবং যারা ডাকবে তাদের ব্যাপারে গাফেল থাকবে। আর আল্লাহ যখন কিয়ামত দিবসে হিসাবের জন্য সব মানুষকে একত্রিত করবেন, তখন ঐসব মিথ্যা মা‘বুদ, যাদেরকে ডাকা হত, তারা দো‘আ প্রার্থনাকারীদের বিপক্ষে যাবে এবং তাদের ইবাদাত উপাসনা অস্বীকার করবে।

{প্রশ্ন: ৭৫} মহান আল্লাহ সূরা আন-নমলের ৬২ নং আয়াতে বলেন:
﴿ أَمَّن يُجِيبُ ٱلۡمُضۡطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكۡشِفُ ٱلسُّوٓءَ ﴾ [النمل: ٦٢] 
‘‘আর কে আছে এমন যে নিরুপায় আর্তের আহ্বানে সাড়া দেয়, যখন সে তাঁকে ডেকে থাকে এবং তার বিপদ-আপদ দূরীভূত করেন’’? এ আয়াতের ব্যাখ্যা ও শিক্ষা কী?
উত্তর: আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন যে, আরব এবং অনারব মুশরিক সম্প্রদায় ভালো করেই জানে যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউই অসহায়-আর্তের ডাকে সাড়া দিতে এবং বিপদ আপদ দূরীভূত করতে সক্ষম নয়। সত্য জানার পরেও কেন তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুকে মা‘বুদ এবং শাফা‘আতকারী হিসেবে গ্রহণ করে? তাদেরকে আল্লাহ ছুবাহানাহু অতাআলা অজ্ঞ-মূর্খ অসু্স্থ মস্তিস্কের বিভ্রান্ত মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অতএব আল্লাহর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করা সম্পূর্ণ অবৈধ; কেননা একমাত্র আল্লাহই অসহায় আর্তের ডাকে সাড়া দেন এবং বিপদ-আপদ দূরীভূত করেন।
সুতরাং আয়াতের শিক্ষা হলো: যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে বিপদ-আপদ এবং অসহায়ত্ব দূরীভূত করার জন্যে প্রার্থনা করবে সে আল্লাহর সাথে শরীক করলো।

{প্রশ্ন:৭৬} আবু-হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
" إِذَا قَضَى اللَّهُ الأَمْرَ فِي السَّمَاءِ، ضَرَبَتِ المَلاَئِكَةُ بِأَجْنِحَتِهَا خُضْعَانًا لِقَوْلِهِ، كَأَنَّهُ سِلْسِلَةٌ عَلَى صَفْوَانٍ، ينفذهم ذلك، فَإِذَا فُزِّعَ عَنْ قُلُوبِهِمْ قَالُوا: مَاذَا قَالَ رَبُّكُمْ؟ قَالُوا لِلَّذِي قَالَ: الحَقَّ، وَهُوَ العَلِيُّ الكَبِيرُ، فَيَسْمَعُهَا مُسْتَرِقُ السَّمْعِ، وَمُسْتَرِقُ السَّمْعِ هَكَذَا بَعْضُهُ فَوْقَ بَعْضٍ - وَوَصَفَ سُفْيَانُ بِكَفِّهِ فَحَرَفَهَا، وَبَدَّدَ بَيْنَ أَصَابِعِهِ - فَيَسْمَعُ الكَلِمَةَ فَيُلْقِيهَا إِلَى مَنْ تَحْتَهُ، ثُمَّ يُلْقِيهَا الآخَرُ إِلَى مَنْ تَحْتَهُ، حَتَّى يُلْقِيَهَا عَلَى لِسَانِ السَّاحِرِ أَوِ الكَاهِنِ، فَرُبَّمَا أَدْرَكَ الشِّهَابُ قَبْلَ أَنْ يُلْقِيَهَا، وَرُبَّمَا أَلْقَاهَا قَبْلَ أَنْ يُدْرِكَهُ، فَيَكْذِبُ مَعَهَا مِائَةَ كَذْبَةٍ، فَيُقَالُ: أَلَيْسَ قَدْ قَالَ لَنَا يَوْمَ كَذَا وَكَذَا: كَذَا وَكَذَا، فَيُصَدَّقُ بِتِلْكَ الكَلِمَةِ الَّتِي سَمِعَ مِنَ السَّمَاءِ "
‘‘আল্লাহ আসমান হতে যখন কোনো ফরমান জারি করেন তখন ফিরিশতা ডানা ঝাপটে ঐ মহত্বপূর্ণ আদেশের প্রতি বিনয়াবনত সম্মতি, আনুগত্য প্রকাশ্য করে, আল্লাহর কোনো সিদ্ধান্ত বা ফরমান অত্যন্ত স্পষ্টভাবে নাযিল হওয়ার প্রাক্কালে তা প্রচ্ছন্ন পাথরের উপর লোহার শিকলের হৃদয়গ্রাহী ঝনঝন শব্দের তরঙ্গ মালার ন্যায় ফিরিশতাদের অন্তরে গ্রথিত হয়ে যায়। অতঃপর যখন তাদের ক্বলবের উপর হতে সে চাপ দূরীভূত হয়ে যায় তখন তারা তাদের পরস্পরকে প্রশ্ন করে বলে, তোমাদের রব্ব কি বলেছেন? তারা বলে: সর্বশ্রেষ্ট আল্লাহ শাশ্বত সত্য বলেছেন। ফেরেশতাদের পারস্পরিক কথোপকথন জ্বিন শয়তান ওৎ পেতে শ্রবণ করে। এ শয়তানগুলো একটার উপরে অপরটা অবস্থান করে থাকে (সুফিয়ান হাত সম্প্রসারিত করে এবং আংগুলসমূহ ফাঁকা করে একটার উপরে অপরটা কীভাবে অবস্থান নেয় তা বুঝিয়ে দেন) এবং ফিরিশতাদের নিকটবর্তী ওৎ পেতে থাকা জ্বিন তার নিচের জ্বিনকে শ্রুত কথাগুলো জানিয়ে দেয়। অতঃপর সে তার নিচের জনকে জানায় আর এভাবেই জাদুকর বা গনক ঠাকুরদের কানে পৌছে দেয়। কখনো বা ওৎ পেতে থাকা শয়তান অপরকে জানানোর পূর্বেই ওৎ পেতে থাকা শয়তানকে অগ্নি তারকায় আক্রান্ত করে ফলে। আবার কখনোবা আক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই অপরকে জানিয়ে দিতে সক্ষম হয়। অতঃপর জাদু-মন্ত্রণাকারী সত্যের সাথে শত শত মিথ্যার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তাদের কাছে আগত ব্যক্তিকে আশ্চর্যজনক অদ্ভুত করে জানতে চায় সে কি অমুক দিন এরকম এরকম বলে নি? এভাবে আকাশ থেকে শ্রবণকৃত আল্লাহর জারি করা সিদ্ধান্তটিকে মানুষের সত্যয়ণ লাভ করে মানুষ বিভ্রান্ত হয়”। (সহীহ আল-বুখারী, নং ৪৮০০,৮৭০১)
পূর্বোক্ত হাদীসের নিচে দাগ দেওয়া বাক্যসমূহের ভাবার্থ কী?
উত্তর: (قَضَى اللَّهُ الأَمْرَ)= আল্লাহ জিব্রিল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে যখন কোনো আদেশ জারি করেন।
(خُضْعَانًا لِقَوْلِه) মহামহিয়ান পবিত্র আল্লাহর আমোঘ বাণী শ্রবণে বিনাবনত আনুগত্য।
(كَأَنَّهُ سِلْسِلَةٌ)= শ্রবনকৃত আদেশ বাণীর শব্দ লৌহ শিকলের শব্দের ন্যায় মনে হত।
(صَفْوَانٍ)= পরিচ্ছন্ন মসৃন পাথর,
(ينفذهم ذلك)= আল্লাহর আদেশ নামা নির্মলভাবে ফেরেশতাদের হৃদয়ে গেথে যায়।
(مُسْتَرِقُ السَّمْعِ) = জ্বিন শয়তান।
(فَحَرَفَهَا) = বাকা করলো।
(وَبَدَّدَ بَيْنَ أَصَابِعِهِ) =জ্বিনেরা ওৎ পেতে চুরি করে কীভাবে আল্লাহর কথা জানার চেষ্টা করে তা বুঝাবার জন্য হাত বাকা করে আংগুলসমূহ ফাক ফাক করে ধরা হয়েছে।
(الشِّهَابُ) = অগ্নি তারকা যা নিক্ষিপ্ত হয়।
(السَّاحِرِ) = জাদুকর, আর এ জাদুকর ভেল্কিবাজী দ্বারা মিথ্যাকে সত্যের ন্যায় উপস্থাপন করে থাকে। তারা মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে চুপি চুপি মিথ্যা ও ধোকাবাজী অপতৎপরতা সম্পন্ন করে।
(الكَاهِنِ) = যে গায়ের অদৃশ্য জানার দাবী করে[28]।

{প্রশ্ন: ৭৭} সুমহান আল্লাহ বলেন:
﴿ يُؤۡمِنُونَ بِٱلۡجِبۡتِ وَٱلطَّٰغُوتِ ﴾ [النساء: ٥١] 
তারা জিবত এবং তাগুতের প্রতি ঈমান রাখে বা বিশ্বাস করে’’ (আন-নিসা: ৫১) এখানে জিবত এবং তাগুত কী?
উত্তর: খাত্তাবের পূত্র উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: জিবত অর্থ জাদু-বান টোনা, আর তাগুত হলো শয়তান। অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত যার ইবাদাত করা হয় এবং সে যদি তাতে সন্তুষ্ট থাকে তাহলেই সে তাগুত বলে গণ্য হবে।

{প্রশ্ন: ৭৮} তাগুত সম্পর্কে জাবির রাদিয়াল্লাহ আনহু বলেন যে; এরা হলো গনক-ঠাকুর সম্প্রদায়, প্রত্যেক গোত্রে বা মহল্লায় তাদের একজন থাকে’। জাবের রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর একথার অর্থ কী? এবং (الحي) ‘আল-হাই’ কাকে বলে?
উত্তর: জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু যা বুঝিয়েছেন তা হলো: গনক-ঠাকুর জ্যোতিষরা তাগুতের অন্তর্ভুক্ত। শয়তান তাদের কাছে এসে তথাকথিত গোপন তথ্য (সত্য-মিথ্যা সংমিশ্রিত) প্রদান করে থাকে।
(وفي كل حي واحد) আল হাই (الحي) হচ্ছে কবিলা, জ্ঞাতি-গোষ্ঠি। অর্থাৎ প্রত্যেক গোষ্ঠির মধ্যে যে ব্যক্তি গনক-ঠাকুর বা জাদু মন্ত্রের কাজ করে থাকে।[29]

{প্রশ্ন: ৭৯} কুফর কত প্রকার?
উত্তর: কুফর দুই প্রকার:
(১) বড় কুফর (২) ছোট কুফর।
মহান আল্লাহ বলেন:
 ﴿ وَضَرَبَ ٱللَّهُ مَثَلٗا قَرۡيَةٗ كَانَتۡ ءَامِنَةٗ مُّطۡمَئِنَّةٗ يَأۡتِيهَا رِزۡقُهَا رَغَدٗا مِّن كُلِّ مَكَانٖ فَكَفَرَتۡ بِأَنۡعُمِ ٱللَّهِ فَأَذَٰقَهَا ٱللَّهُ لِبَاسَ ٱلۡجُوعِ وَٱلۡخَوۡفِ بِمَا كَانُواْ يَصۡنَعُونَ ١١٢ ﴾ [النحل: ١١٢] 
‘‘আল্লাহ এক জনপদের দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন আর তা ছিল এক নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত জনপদ; যেখানে সর্বদিক হতে আসত প্রচুর জীবনোপকরণ। অতঃপর তারা আল্লাহর নিয়ামত -অনুগ্রহ অস্বীকার (অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ) করলো। আর আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে আস্বাদন করলেন ও ভয়-ভীতির আচ্ছাদন বা পোষাক’’। (আন-নাহল:১১২)
আর যে বড় কুফরীতে লিপ্ত হবে সে মুসলিম মিল্লাত হতে বহিষ্কৃত হয়ে যাবে বা মুসলিম থাকবে না। তবে ছোট কুফরিতে লিপ্ত ব্যক্তিও প্রর্যায়ক্রমে বড় কুফরীতে নিমজ্জিত হয়।

{প্রশ্ন: ৮০} নিফাক কত প্রকার?
উত্তর: নিফাক দুই প্রকার;
(এক) বিশ্বাসগত (অন্তরে) নিফাক, এ নিফাকে জড়িত ব্যক্তি মুসলিম থাকবে না। (নিফাকের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা পর্যালোচনার জন্য সূরা আত-তাওবা অধ্যায়ন করা দরকার)
(দুই) কাজ ও কর্মে নিফাক; এ প্রকারের নিফাক পাঁচ প্রকার। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
" آيَةُ المُنَافِقِ ثَلاَثٌ: إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ " وفي رواية: وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ "
‘‘মুনাফিকের আলামত বা লক্ষণ তিনটি: কথায় কথায় মিথ্যা বলা, ওয়াদা দিয়ে তা লঙ্ঘন করা, আমানত রাখা হলে তার খিয়ানত করা’’।
অন্য এক বর্ণনায় আছে:  ‘‘চুক্তি-সন্ধি ভংগ করা ও ঝগড়া-বিবাদ কালে অশ্লীল কথা বলা’’। (বুখারী ৩৩, ৩৪)

{প্রশ্ন: ৮১} ইসলাম বিনষ্টের কারণ কী কী?
উত্তর: ইসলাম বিনষ্টের কারণ কয়টি তা নিয়ে মত পার্থক্য আছে।
কেউ কেউ বলেছেন ৮০টি। তন্মধ্য থেকে কয়েকটি হলো:
(ক) আল্লাহর সাথে শির্ক করা।
(খ) জাদু-মন্ত্র।
(গ) আল্লাহর পক্ষ থেকে যা এসেছে অতঃপর তাঁর নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা উপস্থাপন করেছেন তার কোনো কিছুকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
(ঘ) আল্লাহর নাযিলকৃত আইন-বিধান ব্যতীত অন্যকোনো বিধানকে বৈধ হিসেবে বিশ্বাস বা গ্রহণ করে শাসনকার্য পরিচালনা করা।
(ঙ) নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপস্থাপিত কোনো কিছুকে উপহাস ঠাট্রা-বিদ্রূপ করা।
(চ) দীন ইসলামের কোনো প্রকার ক্ষতি হলে এবং মর্যাদা হ্রাস পেলে আনন্দিত হওয়া।
(ছ) নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছু পেশ করেছেন যা কিছু পেশ করেছেন তা অবজ্ঞা-অপছন্দ করা।
(জ) কাফের-কুফরকে মহব্বত বা আনুগত্য, অনুসরণ করা।
(ঝ) নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হিদায়াত (মুক্তির বিধান) ব্যতীত অন্য কোনো মতবাদকে উত্তম বলে বিশ্বাস ও গ্রহণ করা।

{প্রশ্ন: ৮২} শাফা‘আত (সুপারিশ) কাকে বলে এবং তা কত প্রকার ও কী কী?
উত্তর: কোনো উপকার অর্জন অথবা বিপদ হতে উদ্ধারের লক্ষ্যে অন্য কাউকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করাকে শাফা‘আত বলে।
শাফা‘আত দুই প্রকার;
(ক) কার্যকর ইতিবাচক শাফা‘আত: এ প্রকার শাফা‘আতের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা। তিনি যার কথা ও কাজে সন্তুষ্ট আল্লাহর অনুমতিতে সে শাফা‘আত করতে পারে। অথবা যে শাফা‘আত করার উপযুক্ত, সক্ষম তার কাছে শাফা‘আত চাওয়া।
(খ) নেতিবাচক বা নিষিদ্ধ শাফা‘আত: যে সব বিষয় আল্লাহ ব্যতীত অন্যের পক্ষে সম্পন্ন (সমাধান) করা অসম্ভব সে সব বিষয়ে অন্যের কাছে শাফা‘আত (সুপারিশ) চাওয়া। আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত শাফা‘আত করা অবৈধ বৃথা তৎপরতা। যারা আল্লাহর সাথে কোনো কিছু শরীক করে তাদের জন্য শাফা‘আত বা সুপারিশ করাও নিষিদ্ধ[30]।

{প্রশ্ন: ৮৩} কার্যকরী শাফা‘আতের শর্ত ও দলীল কি?
উত্তর: শর্ত দুটি;
(এক) শাফা‘আতকারীর জন্য আল্লাহর অনুমতি পাওয়া। যেমন; মহান আল্লাহ বলেন: 
﴿ مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ﴾ [البقرة: ٢٥٥] 
‘‘কে আছে এমন যে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া তার কাছে শাফা‘আত (সুপারিশ) করবে’’? (সূরা আল-বাকারাহ: ২৫৫)
(দুই)যার জন্য শাফা‘আত করা হবে তার ব্যাপারে আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকতে হবে। যেমন; মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ وَلَا يَشۡفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ٱرۡتَضَىٰ ﴾ [الانبياء: ٢٨] 
‘‘যার প্রতি তিনি (আল্লাহ) সন্তুষ্ট বা রাজি নন তার জন্য তারা শাফা‘আত করবে না’’। (সূরা আল-আম্বিয়া: ২৮)

{প্রশ্ন: ৮৪} আখিরাতে নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফা‘আত কয় প্রকার ও কী কী?
উত্তর:  নবী মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শাফা‘আত ছয় প্রকার:
(ক) বৃহৎ শাফা‘আত;  আখিরাত দিবসে হাশরের ময়দানের কষ্টলাঘবের জন্য মানুষ যখন উঁচুপর্যায়ের রসূলগণকে একজনের পর অন্যজনকে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করার জন্য বলবে তখন তাঁরা অপারগতা প্রকাশ করবেন। সবার শেষে নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এলে তিনি বলবেন যে, আমি তোমাদের জন্য এ শাফা‘আত করবো।
(খ) জান্নাতবাসীদের জন্য জান্নাতে প্রবেশের শাফা‘আত।
(গ) নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মতের মধ্যে যারা গুনাহগার তাদের মধ্য হতে যাদেরকে সম্ভব জাহান্নামে প্রবেশ না করার শাফা‘আত।
(ঘ)যারা গুনাহগার কিন্তু আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী তাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির সুপারিশ-শাফা‘আত।
(ঙ) যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে তাদের সওয়াব ও মর্যাদা বৃদ্ধির শাফা‘আত।
(চ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চাচা আবু তালেবের আযাব হ্রাস করার শাফা‘আত।

{প্রশ্ন: ৮৫} নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শাফা‘আত পেয়ে কে সবচেয়ে সুখী হবে? আর এ শাফা‘আতের হাকীকত (তাৎপর্য) কী এবং শাফা‘আত কার জন্যে নির্ধারিত?
উত্তর: নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শাফা‘আত পেয়ে সেই বেশী সুখী হবে যে অন্তর থেকে খালেছভাবে বলবে ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’। (বা আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো মা‘বুদ নেই)
আর শাফা‘আতের হাকীকত হলো: মহা গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী আল্লাহ যাদেরকে শাফা‘আতের অনুমতি দেন তাদের দো‘আর মাধ্যমে একনিষ্ঠ মুখলিছ, তাওহীদ পন্থী নেক বান্দাদের গুনাহ মাফ করে দিবেন।

{প্রশ্ন: ৮৬} আল-কুরআনে কোন ধরনের শাফা‘আত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে?
উত্তর: শির্কযুক্ত শাফা‘আত; যা নিষিদ্ধ ও বর্জনীয়।

{প্রশ্ন: ৮৭} মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ﴾ [البقرة: ٢٥٥] 
‘‘কে আছে এমন যে আল্লাহর নিকট হতে অনুমতি ছাড়া শাফা‘আত করতে পারে’’? (সূরা আল বাক্বারাহ: ২৫৫) এ আয়াতের ভাবার্থ এবং নাযিল হওয়ার উপলক্ষ্যই বা কী?
উত্তর: মহান আল্লাহ বলছেন যে, আখিরাতে তাঁর অনুমতি ছাড়া শাফা‘আত কার্যকর হবে না।
উক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ: অংশিবাদী মুশরিক সম্প্রদায় বলতো, আমরা প্রতিমাদের ইবাদাত করি এ জন্য যে তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দিবে। মহান আল্লাহ তাদের কথার উল্লেখ করেছেন সূরা যুমারে ৩ নং আয়াতে:
﴿ مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ ﴾ [الزمر: ٣] 
‘‘আমরা তাদের ইবাদাত এ জন্য করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়’’। (সূরা আয-যুমার)

{প্রশ্ন:৮৮} মহামহিয়ান আল্লাহ বলেন:
﴿ إِنَّكَ لَا تَهۡدِي مَنۡ أَحۡبَبۡتَ ﴾ [القصص: ٥٦]   
‘‘আপনি ভালবেসে যাকে ইচ্ছা (পছন্দ) তাকে হেদায়েত করতে পারবেন না’’। (সূরা আল-ক্বাসাস: ৫৬)
এ আয়াতের ভাবার্থ ও নাযিল হওয়ার উপলক্ষ্য কী?
উত্তর: মহান আল্লাহ তাঁর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উদ্দেশ্যে বলেন: আপনি যাকে ভালোবাসেন তাকে কল্যাণের পথে আনতে চান, তা আপনি পারবেন না। অর্থাৎ হেদায়াতের মালিক আপনি নন বরং আপনার কর্তব্য হলো সত্যের (হেদায়াতের) দিকে আহ্বান করা। এ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়েত করবেন। কে হেদায়েত পাওয়ার উপযুক্ত তা একমাত্র আল্লাহই পরিপূর্ণভাবে অবগত এবং এ বিষয়ে তিনিই সর্বময় হিকমতের আধিকারী।
আর আয়াত নাযিলের উপলক্ষ্য: যখন নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার চাচা আবু তালেবকে দীন ইসলাম কবুল করানোর জন্য নিষ্ঠার সাথে জোর চেষ্টা করছিলেন তখন এ আয়াত নাযিল হয়।

{প্রশ্ন:৮৯} হিদায়াত কত প্রকার ও কী কী; উদাহরণ দিন?
উত্তর: হিদায়াত দুই প্রকার:
(এক) হিদায়াতুত তাওফীক (হিদায়াত লাভে সক্ষমতা অর্জন করা)। আর এটা হলো পথভ্রষ্টের ক্বলবে হেদায়েতের আবির্ভাব ঘটানো। আলোচ্য আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ প্রকার হেদায়েত দান করার সাধ্য আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। যেমন মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ إِنَّكَ لَا تَهۡدِي مَنۡ أَحۡبَبۡتَ ﴾ [القصص: ٥٦]   
‘‘আপনি যাকে ভালোবাসেন তাকেই হিদায়াত করতে পারবে না’’। (সূরা আল-কাসাস:৫৬)
অর্থাৎ আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তাকে হিদায়াত প্রদান করার কোনোই সাধ্য নেই।
(দুই) দলীল প্রমাণ সহ হিদায়াতের পরিচয় পাওয়া বা দেওয়া। যেমন; মহান আল্লাহ বলেন:
 ﴿ وَإِنَّكَ لَتَهۡدِيٓ إِلَىٰ صِرَٰطٖ مُّسۡتَقِيمٖ ﴾ [الشورا: ٥٢] 
‘‘আর আপনি তো সরল-সোজা পথের সন্ধান দিয়ে থাকেন’’। (সূরা আশ-শূরা: ৫২)
সুতরাং এ প্রকারের হিদায়াতের বিষয়বস্তু আল্লাহর দীন ও শরীয়াতের প্রমাণ সহ আল্লাহর পক্ষ থেকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা সহ দূনিয়াবাসীর কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে।

{প্রশ্ন: ৯০} আল্লাহ বলেন:
﴿ يَٰٓأَهۡلَ ٱلۡكِتَٰبِ لَا تَغۡلُواْ فِي دِينِكُمۡ ﴾ [النساء: ١٧١] 
‘‘হে আহলে কিতাব সম্প্রদায় তোমরা তোমাদের (জন্য নাযিলকৃত) দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না। (সূরা আন-নিসা: ১৭১) এ আয়াতের ভাবার্থ কী? আয়াতের মধ্যে উল্লিখিত গুলু (غلو) কাকে বলে?
উত্তর: আহলে কিতাব অর্থাৎ ইয়াহূদী এবং খ্রষ্টানদের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ বলেন যে, তোমরা দীনের ব্যাপারে আল্লাহর নির্ধারিত সীমালঙ্ঘন করো না। আর আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিকে যে সীমিত সম্মান দিয়েছেন তা থেকে বেশী সম্মান করতে যেও না। এইরূপ করা অন্যায়; কেননা অসীম সম্মান মর্যাদার অধিকারী আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ নয়।
আর গুলু হচ্ছে; সীমা লংঘন, শ্রদ্ধা সম্মানের ক্ষেত্রে কথায় ও বিশ্বাসে অতিরঞ্জন।

{প্রশ্ন: ৯১} আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহ আনহুমা থেকে সহীহ সূত্রে আল্লাহর এ বাণী:
﴿ وَقَالُواْ لَا تَذَرُنَّ ءَالِهَتَكُمۡ وَلَا تَذَرُنَّ وَدّٗا وَلَا سُوَاعٗا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسۡرٗا ٢٣ ﴾ [نوح: ٢٣] 
‘‘আর তারা বলেছিল তোমরা তোমাদের ইলাহদেরকে (দেব-দেবী) পরিত্যাগ করবে না এবং ওয়াদ, সূয়া, ইয়াগু, ইয়াউক, নাসর এদেরকেও পরিত্যাগ করবে না’’। (আন-নূহ: ২৩) প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন:
‘‘এ (আয়াতে উল্লিখিত) নামসমূহ নূহ আ: এর কাওমের সৎ লোকদের। তাদের মৃত্যুর পর তাদের অনুরূপ ছবি-মূর্তি তৈরী করে নাম উল্লেখ সহকারে বসবাসের জায়গায় সাজিয়ে রাখার জন্য ঐ কওমের লোকদেরকে শয়তান প্ররোচিত করলো। আর (ঐ সৎ ব্যক্তিদের) কাওমের লোকেরা শয়তানের প্ররোচনা অনুযায়ী কাজ করলো তবে এরা  মূর্তি পূজায় লিপ্ত হয়নি। কিন্তু এদের মৃত্যু পরবর্তী প্রজন্মের নিকট থেকে তাওহীদের জ্ঞান বিলুপ্ত হওয়ার ফলে তারা সৎব্যক্তিদের মূর্তিগুলোর ইবাদাত শুরু করে দেয়’’। (বুখারী: ২৬৩ আল-যুবাইদি পৃ: ৯১)
হাদীসে উল্লেখিত ছবি মূর্তি দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে? এ সব মূর্তির ইবাদাত করার কারণ কী? ইলেম ভুলে যাওয়ার তাৎপর্য কী?
উত্তর: এখানে ছবি মূর্তি বলতে: নেক ও সৎকর্মপরায়ন ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি বুঝানো হয়েছে।
তাদের ইবাদাতের কারণ হলো: পূর্ব-পরুষগণ নেক লোকদের মৃত্যুর পর তাদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাজিম, সম্মান ও ভক্তি প্রকাশ করার জন্য কবরের কাছে আস্তানা গড়ে তুলে এবং কবরবাসীদের প্রতিকৃতি গৃহভ্যন্তরে সাজিয়ে রাখে। অতঃপর তাদের পরবর্তী লোকদেরকে শয়তান এ বলে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয় যে,  তোমাদের পূর্ব পুরুষরা ঐ সব প্রতিকৃতির ইবাদাত-উপাসনা করতো এবং বৃষ্টি বর্ষণের প্রার্থনা জানাত।
ইলম (জ্ঞান-বিদ্যা) ভূলে যাওয়া বা বিলুপ্ত হওয়ার অর্থ হচ্ছে:
সত্যনিষ্ঠ দীন প্রচারক, আলেম-ওলামা ও বিদ্বানগণের প্রস্থান বা মৃত্যু হওয়া।

{প্রশ্ন: ৯২} ইবনুল ক্বাইয়েম বলেন: একদিকে সালাফে সালেহীন বলেছেন; ঐ সৎকর্মপরায়ন ব্যক্তিদের মৃত্যুর পর তাদের পরবর্তী লোকেরা কবরের কাছে ই‘তিকাফ শুরু করে দেয়। অতঃপর কবরবাসীদের প্রতিকৃতি (তামাসিল) স্থাপন করে। এভাবে অনেকদিন (আল-আমাদ) অতিবাহিত হওয়ার পর স্থাপিত ঐ প্রতিকৃতি তথা কবরপূজা চালু হয়।
কবরের কাছে ই‘তিকাফ করার অর্থ কী? তামাসিল কী বস্তু? ‘আল-আমাদ’ অর্থ কী?
উত্তর: কবরে ই‘তিকাফ করার অর্থ হচ্ছে; কবর কেন্দ্রিক আস্তনায় ধর্ণা দেওয়া আর তামাসিল হলো; মূর্তি, সাদৃশ্য, প্রতিকৃতি বা ছবি। আল-আমাদ অর্থ হলো: সময়কাল।

{প্রশ্ন:৯৩} ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহ আনহুমা বলেন: রাসূল সল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
(غلو) ‘‘অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি করার ব্যাপারে তোমাদেরকে সাবধান করছি। তোমাদের পূর্ববর্তী যারা বাড়াবাড়ি করেছিল তারা ধ্বংস হয়ে গেছে’’। (মুসনাদে আহমাদ ১/২১৫, নাসায়ী ৫/২৬৮, ইবনে মাজাহ; ৩০২৯)
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা কী?
উত্তর: নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতকে সতর্ক করে দিয়েছেন যেন তারা পূর্ববর্তী উম্মতের মত নবী ও নেককার লোকদেরকে ভক্তি-শ্রদ্ধায় আতিরঞ্জন করে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত না হয়। কেননা পূর্ববর্তী উম্মতের কতিপয় লোক নবী ও নেক ব্যক্তিদের ভক্তি-সম্মান ও মর্যাদায় সীমালঙ্ঘন করার ফলে ধ্বংসের মধ্যে নিপতিত হয়েছে।

{প্রশ্ন: ৯৪} ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহ আনহ হতে বর্ণিত আছে যে, নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: (মুতানাত্তে‘উন) ‘‘বাড়াবাড়িকারীরা ধ্বংস হোক’’; এ কথাটি তিনবার উচ্চারণ করেন। (মুসলিম- ২৬৭০)
মুতানাত্তেউন কারা? (هلك) ধ্বংস হোক কথাটি তিনবার বলার কারণ কী? তানাত্তু‘ কী এবং এর উদাহরণ কী?
উত্তর: মুতানাত্তে‘উন এবং তানাত্তু‘ হচ্ছে; কোনো বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জনের ভাব প্রকাশ করা এবং ঐ বিষয়ে পারদর্শীতা দেখানোর চেষ্টা করা। যেমন; বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করা, আলাপ-আলোচনায় তাত্বিকভাব ফুটিয়ে তোলা, মুবাহ বা সাধারণ বৈধ জিনিস হতে নিজকে বিরত রাখা।
এ কথা তিনবার বলার কারণ হচ্ছে; গুরুত্ব অনুধাবন করে সর্তকতা অবলম্বন করা।

{প্রশ্ন: ৯৫} আয়েশা রাদিয়াল্লাহ আনহা থেকে বর্ণিত আছে; উম্মে হাবীবা ও উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানালেন যে, তারা হাবাশায় (আবিসিনিয়া বা ইথিওপিয়ায়) গীর্জা দেখেছেন এবং গীর্জার ভিতরে ছবি-প্রতিকৃতি ছিল। অতঃপর নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,  
«إِنَّ أُولَئِكَ إِذَا كَانَ فِيهِمُ الرَّجُلُ الصَّالِحُ فَمَاتَ، بَنَوْا عَلَى قَبْرِهِ مَسْجِدًا، وَصَوَّرُوا فِيهِ تِلْكَ الصُّوَرَ، فَأُولَئِكَ شِرَارُ الخَلْقِ عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ القِيَامَةِ»
‘‘সেখানে কোনো সৎকর্মপরায়ন ব্যক্তি বা নেক বান্দার মৃত্যুর পর ঐ জনপদের লোকেরা কবরের সন্নিকটে মসজিদ বানিয়েছে অতঃপর কবরবাসীদের প্রতিকৃতি তৈরী করে লটকিয়ে রেখেছে। যে লোকেরা ঐ কাজ করছে তারা আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম জীবের অন্তর্ভুক্ত।’’ (মুত্তাফিকুন আলাইহি: বুখারী, ৪২৭; মুসলিম, ৫২৮)
হাদীসে যে দু’টি ফিতনার উল্লেখ হয়েছে তা হলো: (ক) কবরের ফিতনা (খ) মূর্তির ফিতনা। এখানে কানীসা বলে কী বুঝানো হয়েছে? আর ‘ঐ লোকদের’ কথা বলে কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? ঐ লোকেরা বলতে কাদের দিকে ইশারা করা হয়েছে?
উত্তর: ‘কানীসা’ হচ্ছে খ্রীষ্টানদের গীর্জা বা উপাসনালয়। ঐ লোকদের সম্পর্কে উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে ধারণা দেওয়া হয়েছে। ঐ লোকেরা বলতে বুঝানো হয়েছে তাদেরকে যারা কবরের কাছে মসজিদের নামে আস্তানা গড়ে তোলে এবং সমাধিস্ত ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি তৈরি ও সংরক্ষণ করে।

{প্রশ্ন:৯৬} আল্লাহর নিকট নিকৃষ্ট জীব কারা? কেন তারা নিকৃষ্ট জীব হিসেবে পরিগণিত হলো?
উত্তর: যারা কবরের পাশে মসজিদ নির্মান করে এবং সেখানে কবরস্ত লোকদের ছবি-প্রতিকৃতি স্থাপন করে তারাই নিকৃষ্ট জীব।
তারা নিকৃষ্ট জীব হিসেবে পরিগণিত হওয়ার কারণ হলো; তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়ে আবার অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করে থাকে। আর পরবর্তী লোকদেরকে পথভ্রষ্ট হবার উপায় ও উপকরণ আবিস্কার করে দিয়ে যায়। অতঃপর মৃত্যুবরণকারী নেক লোকদের কবর কেন্দ্রিক সীমালংঘনের এক পর্যায়ে কবর পূজা শুরু করে দেয়।

{প্রশ্ন:৯৭} কবর বা সমাধি স্থানের কাছা-কাছি মসজিদ নির্মাণের হুকুম কী? প্রমাণ দিন?
উত্তর: হারাম। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘তারা আল্লাহর নিকট নিকৃষ্ট জীব।’’ তাছাড়া নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং নিষেধ করেছেন এবং যারা ঐ কাজ করবে তাদেরকে লা‘নত বা অভিশাপ দিয়েছেন।

{প্রশ্ন: ৯৮} মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ لَقَدۡ جَآءَكُمۡ رَسُولٞ مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ عَزِيزٌ عَلَيۡهِ مَا عَنِتُّمۡ حَرِيصٌ عَلَيۡكُم بِٱلۡمُؤۡمِنِينَ رَءُوفٞ رَّحِيمٞ ١٢٨ ﴾ [التوبة: ١٢٨] 
‘‘তোমাদের কাছে রাসূল এসেছেন তোমাদের মধ্য থেকেই। তোমাদের দুঃখ-কষ্টে তিনি ব্যাথিত হন। তিনি তোমাদের কল্যাণে মনোযোগী আর তিনি মুমিনদের প্রতি স্নেহময় ও দয়ালু’’। (সূরা আত-তাওবা:১২৮)
এ আয়াতের ভাবার্থ কী? আয়াতে নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যে কয়টি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে তা থেকে উম্মতের শিক্ষণীয় কিছু আছে কি?
উত্তর: আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে তাঁর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে বলেন যে, তাদের কাছে রাসূল প্রেরণ করা হয়েছে। আর তিনি তাদের মধ্য থেকে নির্ধারিত। অর্থাৎ তাদের মতই মানুষ এবং ভাষাও অভিন্ন। তাদের কাছে তিনি পরিচিত, বিশ্বস্ত এবং আমানতের সুখ্যাতি স্বীকৃত।
অতঃপর আল্লাহ নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রশংসনীয় কিছু গুণ-বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেন,  যথা; তিনি তার আশে-পাশের লোকদের হিদায়াতের জন্য যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালাতেন, তাদেরকে সুপরামর্শ দিতেন এবং ইসলাম গ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। তাদের কোনো বিপদ-আপদ হলে তিনি পেরেশান হয়ে যেতেন। আর তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের কোনো ক্ষতি তাঁর কাছে অপছন্দনীয়। তাছাড়াও মুমিনদের প্রতি রয়েছে তাঁর স্নেহের পরশ ও দয়া।
 এ সব গুণ-বৈশিষ্ট্য থেকে উম্মতের শিক্ষণীয় হলো: আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসুলের গুণ-বৈশিষ্টসমূহ উল্লেখ করেছেন যেন উম্মতের চেতনা হয়। আর তাদের প্রয়োজনেই রাসূলের আবির্ভাব তিনি তাদেরকে সাবধান বাণী শুনিয়ে শির্কের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন এবং শির্ক হচ্ছে সবচেয়ে বড় গুনাহ। যে সব কারণে শির্কে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে তার বর্ণনা করেছেন। অত্যন্ত জোর দিয়েই তিনি শির্ক করতে নিষেধ করেছেন যার মধ্যে আছে কবরের তাজীম-সম্মান এবং বাড়াবাড়ি করা। কবরের কাছে সালাত পড়া এবং অন্যান্য কার্যকলাপ যা কবর পূজা হিসেবে বিবেচিত।

{প্রশ্ন:৯৯} সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত; নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম:
"إِنَّ اللهَ زَوَى لِي الْأَرْضَ، فَرَأَيْتُ مَشَارِقَهَا وَمَغَارِبَهَا، وَإِنَّ أُمَّتِي سَيَبْلُغُ مُلْكُهَا مَا زُوِيَ لِي مِنْهَا، وَأُعْطِيتُ الْكَنْزَيْنِ الْأَحْمَرَ وَالْأَبْيَضَ، وَإِنِّي سَأَلْتُ رَبِّي لِأُمَّتِي أَنْ لَا يُهْلِكَهَا بِسَنَةٍ عَامَّةٍ، وَأَنْ لَا يُسَلِّطَ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ سِوَى أَنْفُسِهِمْ، فَيَسْتَبِيحَ بَيْضَتَهُمْ، وَإِنَّ رَبِّي قَالَ: يَا مُحَمَّدُ إِنِّي إِذَا قَضَيْتُ قَضَاءً فَإِنَّهُ لَا يُرَدُّ، وَإِنِّي أَعْطَيْتُكَ لِأُمَّتِكَ أَنْ لَا أُهْلِكَهُمْ بِسَنَةٍ عَامَّةٍ، وَأَنْ لَا أُسَلِّطَ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ سِوَى أَنْفُسِهِمْ، يَسْتَبِيحُ بَيْضَتَهُمْ، وَلَوِ اجْتَمَعَ عَلَيْهِمْ مَنْ بِأَقْطَارِهَا - أَوْ قَالَ مَنْ بَيْنَ أَقْطَارِهَا - حَتَّى يَكُونَ بَعْضُهُمْ يُهْلِكُ بَعْضًا، وَيَسْبِي بَعْضُهُمْ بَعْضًا "
‘‘অবশ্যই আল্লাহ আমার জন্য যমীনকে সংকুচিত করে দেখালেন। অতঃপর আমি পৃথিবীর পূর্বপ্রান্ত হতে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত দেখতে পেলাম। অবশ্যই আমার উম্মতের কর্তৃত্ব ঐ পর্যন্ত পৌছবে যে পর্যন্ত আমাকে সংকোচন করে দেখানো হয়েছে। আমাকে লাল (কায়সার) ও শ্বেত বর্ণের (কিসরা) দুটি ভাণ্ডার (স্বর্ণ ও রৌপ্য) প্রদান করা হয়েছে। আর আমি আল্লাহর কাছে আবেদন করেছি, তিনি যেন আমার উম্মতকে মহামারী দিয়ে ধ্বংস করে না দেন এবং অন্য জাতিকে এ উম্মতের উপর যেন এমন ব্যাপক নিরংকুশ বিজয় না দেন যার মাধ্যমে তাদের ছোট বড় সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে, তবে এ উম্মতের নিজেদের ব্যাপার ভিন্ন। এরপর আমার রব্ব আমাকে বললেন; হে মুহাম্মদ; ‘আমি যদি কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলি তবে তা পরিবর্তন করা হয় না। তোমাকে এবং তোমার উম্মতকে সর্বাত্মকভাবে মহামারী দিয়ে হালাক করে দেব না। আর শত্রুপক্ষ ঐক্যবদ্ধ হয়েও তোমার উম্মতকে সার্বিকভাবে ধ্বংস করতে পারবে না। অথবা বলেছেন: দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত হতে ঐক্যবদ্ধ হলেও তারা তোমার উম্মতকে ধ্বংস করতে পারবে না। তবে এ উম্মতের একে অপরকে ধ্বংস-উৎখাতে লিপ্ত হবে এবং একে অন্যকে বন্দী করায় লিপ্ত থাকবে’’ (মুসলিম: ২৮৮৯ কিতাবুল ফিতান)
(زوى لي)এর অর্থ কী?
উত্তর: অর্থাৎ আল্লাহ আমার জন্যে পৃথিবীকে সংকুচিত করে দেখান আর আমি পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত দেখতে পেলাম এবং তা আমার উম্মতের সাম্রাজ্য বিস্তারিত হওয়ার চিত্র।

{প্রশ্ন: ১০০} রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত সম্রাজ্য বিস্তারের যে খবর বলেছেন তা কি বাস্তবায়িত হয়েছে?
উত্তর: হ্যাঁ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মত পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে স্পেন এবং পূর্ব দিগন্তে ভারত ও চিন দেশ পর্যন্ত সম্রাজ্য বিস্তার করেছে।

{প্রশ্ন: ১০১} পূর্বোক্ত হাদীসে লাল ও সফেদ (শুভ্র) দুটি ভাণ্ডার অর্জনের কথা বলা হয়েছে তা কী এবং কখন অর্জিত হয়েছে?
উত্তর: সফেদ সম্পদের ভাণ্ডার হলো তৎকালীন পারস্যের সম্রাট কিসরার সম্পদ ও ভাণ্ডার যার মধ্যে প্রধান হলো রৌপ্যলংকার সামগ্রী। আর লাল সম্পদের ভাণ্ডার হলো রোম দেশের সম্রাট কাইসারের ভাণ্ডার। আর স্বর্ণই ছিল তাদের প্রধান সম্পদ যা লাল বর্ণের।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্বাভাষ বাস্তবায়িত হয় ওমর ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতকালে মুসলিমরা ঐ দুটি সাম্রাজ্য জয় করার মাধ্যমে। অতঃপর সমস্ত সম্পদ ওমর রাদিয়াল্লাহ আনহুর তত্ত্বাবধানে সমর্পিত হয়।

{প্রশ্ন: ১০২} হাদীসে উল্লিখিত ‘সানাতিন আম্মা’ (سنة عامة) শব্দের ভাবার্থ কী?
উত্তর: অর্থাৎ মহামারী দুর্যোগ, যার ফলে সর্বাত্মক বিপর্যয় দেখা দেয়[31]।

(প্রশ্ন: ১০৩} হাদীসে বর্ণিত; (وَأَنْ لَا يُسَلِّطَ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ سِوَى أَنْفُسِهِمْ، فَيَسْتَبِيحَ بَيْضَتَهُمْ) এর ভাবার্থ কি?
উত্তর: অর্থাৎ আমি আমার রব্বের কাছে উম্মতের জন্যে নিবেদন করলাম যে, তাদের উপর কোনো কাফের সম্প্রদায় যেন এমনভাবে বিজয়লাভ করতে না পারে; যাতে তারা সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে।

{প্রশ্ন: ১০৪} আল্লাহ কি দুশমনদের সর্বাত্মক বিজয় না দেওয়ার ব্যাপারে নবীর আবেদন মঞ্জুর করেছেন? (بَيْضَتَهُمْ) অর্থ কী? হাদীসে বর্ণিত (أَقْطَارِ) দ্বারা কী বুঝায়?
উত্তর: হ্যাঁ, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়েছেন যে, আল্লাহ ঐ আবেদন অনুযায়ী মুসলিমদের উপর দুশমনদেরকে সর্বাত্মক বিজয় ও কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করার সুযোগ দিবেন না। আর তারা মুসলিমদের দেশে ও জনপদে নিরংকুশ আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হবে না। এটাই (أَقْطَارِ) এবং (بَيْضَتَهُمْ) এর অর্থ।
আবার কেউ কেউ বলেন যে, এর অর্থ হলো; অধিকাংশ শত্রু সম্প্রদায় অথবা তাদের একটি সংগবন্ধ দল। তারা সংখ্যায় কম হয়েও দুনিযার সর্বস্থান হতে যদি একত্রিত হয় তবুও নিরংকুশ সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হবে না।

{প্রশ্ন: ১০৫} হাদীসে বর্ণিত; (حَتَّى يَكُونَ بَعْضُهُمْ يُهْلِكُ بَعْضًا، وَيَسْبِي بَعْضُهُمْ بَعْضًا) এর অর্থ কী এবং তা কি সংঘটিত হয়েছে?
উত্তর: অর্থাৎ আল্লাহ কাফেরদেরকে মুমিনদের উপরে নিরংকুশ আধিপত্য বিস্তার করতে দিবেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদারগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কুরআন-হাদীস ভিত্তিক দীন ইসলামকে আঁকড়ে থাকবে। আর যদি নিজেদের মধ্যে মতভেদ, অনৈক্য, খুনা-খুনী, রক্তপাত, লুটতরাজ ইত্যাদি অবস্থা বিরাজ করে তাহলেই কেবল কুফরী শক্তির আধিপত্য বিস্তারলাভ করবে।
বিভিন্ন সময়ে মুসলিম জাতি দীন ইসলামের দাবী অনুযায়ী ঐক্যবদ্ধ থাকতে সক্ষম হয় নি বরং পারস্পরিক দ্বন্দ সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে আর তখনই কুফরী শক্তি আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ পেয়েছে। তাছাড়াও মুসলিমগণ শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদে মনোনিবেশ না করে অন্য কিছুতে বিভোর থেকেছে। অতঃপর মুসলিম জাতির বিপর্যয় হলেও তা দীন ইসলামের কোনো দুর্বলতার কারণে নয় এবং তাতে দীনের শ্রেষ্ঠত্বের কোনো ক্ষতিও হবে না। সুতরাং মুসলিম জাতির দুর্বলতা ও বিপর্যয়কে,  দীন ইসলামের দুর্বলতা ও বিপর্যয় বলার কোনো সুযোগ নেই[32]।


ড. ইবরাহীম ইবন সালেহ আল-খুদ্বায়রী
মাননীয় বিচারপতি, উচ্চতর আদালত, রিয়াদ

অনুবাদ: সরদার জিয়াউল হক ইবন সরদার আবদুস সালাম
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
উৎস: কমিউনিটি কেন্দ্রিক দাওয়াহ ও শিক্ষা প্রচারমূলক সহযোগী অফিস, শেফা, সৌদী আরব

Post a Comment

0 Comments